পাশ্চাত্য সাহিত্যতত্ত্ব ও সমালোচনা পদ্ধতির আলোকে-হাসনাইন সাজ্জাদীর বিজ্ঞান কাব্যতত্ত্ব ।। গিয়াসউদ্দিন চাষা
পাশ্চাত্য সাহিত্যতত্ত্বের বড় অবলম্বন গ্রীক ও রোমান সাহিত্যতত্ত্ব। তার মধ্যে রয়েছেন প্লেটো, এ্যারিস্টটল, হোরেস ও লুঙ্গিনাস’র মৌলিক তত্ত্ব। এই সাহিত্য তত্ত্বের সমালোচনা পদ্ধতির মধ্যে আলোচিত হয় নিউ ক্লাসির্সিজম, রোমান্টি সিজম, রিয়েলিজম, ন্যাচারালিজম, মাকর্সিজম, ফ্রয়েডীয় সাহিত্যতত্ত্ব, ফেমিনিজম, মডার্নিজম ও পোস্টমডার্নিজম। এধারার সর্বশেষ সংযোজন হচ্ছে প্রাচ্যের কবি হাসনাইন সাজ্জাদীর সাইন্সিজম বা বিজ্ঞান কাব্যতত্ত্ব।
সংস্কৃত সাহিত্যে কবি সত্যদ্রষ্টা ও কবি ক্রান্তদর্শী। কবি যেমন সত্য বলবেন, তেমনি কবি তার জাতিকে আগাম- সতর্ক করবেন। কবি যেহেতু জাতির শিক্ষক। একই সাথে তিনি নেতাও। তাই কবির কাজ বিশ্বের সাম্প্রতিক সমস্যাকে চিহ্নিত করে তার সমাধান বলে দেয়া। কবিতা হবে সময়ের ইতিহাস। কবি মানুষের জন্য লিখবেন, তাই কলাকৈবল্য বাদ নয়, কবির কাজ মানুষকে আধুনিক সময়ের চ্যালেজ্ঞ মোকাবেলায় যোগ্যতর জ্ঞান দান করা।
বিজ্ঞান কবি হাসনাইন সাজ্জাদী তার বিজ্ঞান কাব্যতত্ত্বে ৬ দফার কথা বলেছেন এবং ১৮ দফার কার্য নির্দেশনা দিয়েছেন। তার ৬ দফার বিজ্ঞান কাব্যতত্ত্বের মধ্যে রয়েছে; ‘ক. কবিতার উপমা, উৎপ্রেক্ষা ও চিত্রকল্পে বিজ্ঞানমনস্কতা, খ. ধর্মনিরপেক্ষ কবিতা লেখা। ধর্মীয় হানাহানি ও বিদ্বেষের বাইরে গিয়ে আন্তধর্মীয় সম্প্রীতি প্রতিষ্ঠার জন্য বিজ্ঞান কবিতা রচনা করা। মানুষ কবিতা লিখবে মানুষের জন্য। ধর্মীয় মিথ কিংবা বাক্যাবলী যথা সম্ভব পরিহার করবে। যাতে একটি সর্বজনীন ভাষাও কাব্যদর্শন প্রতিষ্ঠা পায়,
গ. নারী পুরুষ লিঙ্গ- বৈষম্য বিরোধী কবিতা। এতে ধনীগরীব, জাত-পাত এবং সাদা-কালোর ব্যবধান ঘুচিয়ে একটি মানবিক সাহিত্য রচিত হবে,
ঘ. কবিতায় বিজ্ঞান সময়কে ধারন করা। কবিতা যেহেতু সময়কে ধরে রাখার তান, তাই বিজ্ঞান কবিতা হবে সময়ের ইতিহাস। সময়ের সমস্যা চিহ্নিত করে এর সমাধান থাকবে কবিতায়। যেমন বরফগলা রোধ, জনসংখ্যার বিস্ফোরণ রোধ পরমাণুর যথেচ্ছ ব্যবহার রোধ, খাদ্যে রাসায়নিকের ব্যবহার বন্ধ, নারীও শিশুর প্রতি সহিংসতা বন্ধ, ধনী-গরীবের ব্যবধান কমিয়ে আনা, পরিবেশ বিপর্যয়রোধ, বিজ্ঞানের সুফলও কুফল নিয়ে আলোচনা, ধর্মীয় হানাহানি বন্ধ, বিজ্ঞান চিন্তার প্রসার, ভাববাদকে নিরুৎসাহিত্য করা এবং বিবর্তনবাদকে মানুষের সামনে সহজ করে তুলে ধরা বিজ্ঞান সময়ের চ্যালেঞ্জ।
ঙ. রিপোর্টিং স্টাইলে সাবলীল ছন্দে দাড়ি, কমার প্রয়োগে কবিতা। যাতে বাক্যের মধ্যে অর্থ পরিষ্কার হয়ে যায়। কবিতার ভাব, ভাষাও গাঁথুনিতে গুরুত্ত্ব প্রদান করা। বাণীতে সাবলীল থাকা। সংস্কৃত ছন্দকে পরিহার করা। বাংলার আদি ছন্দ ধামালী, মাল ঝাঁপ, পয়ার ও লাচারীর মধ্যে থাকা। এক কথায় কথ্য ভাষায় মনের কথাকে সহজ করে কবিতায় বাণীবদ্ধ করা। যাতে একটি ম্যাসেজ থাকবে। থাকবে চমৎকারিত্ব। এবং
চ. ছোট আঙ্গিকে বড় উপমার কবিতা লেখা। প্রতিচ্য ও পাশ্চাত্য আজকাল ছোট কবিতা লেখা হচ্ছে। প্রতিচ্যের জাপান কবিতার ভূমিকা হিসাবে লেখা হত তিনছত্র। কাল ক্রমে তাই হাইকু নামে কবিতায় স্থান লাভ করেছে। প্রাচ্যে আগেই রুবাইয়াত লেখা হত। পাশ্চাত্যে বিশেষ করে আমেরিকায় এখন থ্রি-লাইনার, ফোর-লাইনার কবিতা লেখা হচ্ছে। যা হাইকু এবং রুবাইয়াত এরই নতুন প্রতিস্থাপন বলা যায়। এক কথায় সময় বাঁচানো এখন বড় কাজ হয়ে পড়েছে। কলা পাতার উপমাকে আমরা যত ছোট বুঝি, আকাশ রঙ বললে আর ছোট থাকে না। উপমা তখন অনেক বড় হয়ে যায়। এটাই ছোট ক্যানভাসে বড় উপমার কবিতা রচনা।
এখন আমাদের বিবেচ্য বিষয় হাসনাইন সাজ্জাদীর এ কাব্য-তত্ত্বকে পাশ্চাত্য সাহিত্যতত্ত্ব ও সাহিত্য সমালোচনা পদ্ধতির আলোকে উৎরিয়ে নেয়া যায় কি -না?
আসুন সে আলোচনার দিকেই আলোকপাত করি; সক্রেটিসের ছাত্র হিসাবে প্লেটো নাম করলেও তার নিজস্ব দর্শন আজ বিশ্ব জোড়া। আবার তিনি এরিস্টটলর শিক্ষক ও বটে। ছোট বেলায় তিনি সক্রেটিস ভাবুকও কল্পনাপ্রবন হলেও নিজ বাসভূমিকে আদর্শ রাষ্ট্র হিসাবে গড়ে তোলার স্বপ্ন তার মধ্যে তরুণ বয়স থেকেই ছিল। তার সূক্ষ্ম যুক্তিবাদিতার সাথে দৈব বাণীর এক কবিত্মময় দ্বীপ্তির কথা বলেছেন কবি শেলী। তার ‘রিপাবলিক’ গ্রন্থের তৃতীয়াংশে কবি ও কাব্যের নিয়ন্ত্রন নিয়ে যে ধারণা মিলে তাতে কবির ভাববাদীতাকে অম্লান করে দেয়। শিল্পের নান্দনিকতাকে প্লেটো গুরুত্ব দেন। এক কথায় কলাকৈবল্যবাদ তার মূলচিন্তা যেখানে জীবন থেকে নান্দনিকতা নিয়ে কাব্যের মূল্য উপজীব্য করা হয়। হাসনাইন সাজ্জাদীর কাব্যতত্ত্বে এটা সম্পূর্ণ বিপরীত। তার মতে, শিল্প থেকে জীবনবোধ তৈরী হবে। তাই কবিকে আগে বিজ্ঞানমনস্ক হতে হবে। তাকে ভাববাদ পরিহার করে মার্কসিজমে আদলে জীবনের জন্য শিল্পকে ভাবতে হবে।
লেনিন বলেছেন; সাহিত্য ও সংস্কৃতি চর্চাকে যারা শ্রেণী নিরপেক্ষ বলে কলাকৈবল্যবাদ প্রচার করে তারা নির্মম ভ- ব্যাতিত আর কিছু নয়। তাই যারা এক্ষেত্রে কলাকৈবল্যবাদের কথা বলে তারা আসলে শোষক শ্রেণীর সাহিত্য-সংস্কৃতি, তাদের কাব্যচর্চা ইত্যাদির সঠিক শ্রেণী চরিত্রকে শোষিত শ্রেণীর চোখের আড়াল করার উদ্দেশ্যই তা বলে থাকে (সাম্প্রতিক বিবেচনা, পৃষ্ঠা-৪৭, আহমদ ছফা)। হাসনাইন সাজ্জাদীর মতে, আর্ট ও বিজ্ঞানে কোন পার্থক্য থাকেনা যদি শিল্পী বিজ্ঞান মনস্ক হন। আর্ট অর্থ সৃষ্টি, রূপায়ন। রূপ সৃষ্টির সহায়তার জন্য যে পদ্ধতির অনুসরণ করা হয় তাতে বিজ্ঞান চিন্তা থাকতে হবে। শিল্পের অংশগত সৌন্দর্য্য যদি জীবনবোধ তৈরি করতে না পারে তবে তা কিসের শিল্প, কার শিল্প? এটা তার কাব্যদর্শন। সৌন্দর্য সুষমা সৃষ্টির দ্বারা মানস দ্বীপ্তির লাবন্য বের করে আনতে হবে। সুষম, সুন্দরও সঙ্গতিপূর্ণ- রূপসৃষ্টি করাই বিজ্ঞান কবিতার বৈশিষ্ট্য। আর্ট কর লাইফ রূপে আত্মপ্রকাশ তখনই ঘটবে যখন রূপাতীতের ব্যাঞ্জনায় যথাবহিত শব্দ চয়ন ও সাবলীল ছন্দের রীতিকে গ্রহণ করা হবে। কবিতা শিল্পের বিজ্ঞান ভূমি এখানেই প্রাজ্বল্যমান। চিত্রকর তুলির লিখনে দূরত্ব বা সন্নিকট বুঝানোর জন্য যে- নির্দ্দেশানুযায়ী রেখা অভয়ন করবেন সেখানেও চিত্রকলার বিজ্ঞান থাকবে হয়তো, কিন্তু সৃষ্টি নিয়ামক পদ্ধতির বিজ্ঞানই কবিতার বিজ্ঞান হবে না। কবিতার বিজ্ঞান বলতে বিবর্তনবাদকে অনুকরণ ও সময়ের দাবীকে অনুসরণে রাখতে হবে। বিবর্তন বাদের অনুকরণও সময়ের চিত্র ধারন ব্যতিত বিজ্ঞান কবিতা হয় না। এখানে ভাববাদ ও অধ্যাত্মবাদের সংমিশ্রনে প্লেটোর কাব্যতত্ত্ব বিজ্ঞান যুগের মাপকাটিতে প্রজ্ঞা দৃষ্টির অতীত। লেখক কেবল নিজের যুগের কথা ভাবলে তা কালজয়ী হয়না। চিন্তা হিসাবে প্লেটোর রিপাবলিক ও কাব্যতত্ত্ব স্বপ্নের ফোয়ারা ছিল কিন্তু তার কাব্যতত্ত্ব নিজের যুগের ভাববাদে যাপিত হয়ে পড়াতে এখানে অনুসরণ ও অনুকরণের যোগ্যতা হারিয়ে ফেলছে বলে কবি হাসনাইন সাজ্জাদী মনে করেন। যুগ মানস থেকে যুগ অতীতের অনুসরণে অনাগত চিরন্তনকে খুঁজে নেয়ার ওপর তাকে জোর দিতে দেখা যায়। ওয়ার্ডস্ওয়ার্থের অষ্টাদশ এলিজাবেথীয় হয়েও কালাতীত জীবন মহিমার রূপ খোঁজা এমন কি মধুসুদনের মেঘনাদবধ কাব্যের নিয়তি-নিপীড়িত দূর্বল মানবত্মার অপরাজেয় মহীমার কীর্ন্তন শিল্প- শ্রেষ্ঠত্বেরই নিয়ামক ছিল।
এককথায় কাব্যে বিজ্ঞান-ললিতকলার ধরনধারন ও অভিব্যঞ্জনার প্রতিফলনই বিজ্ঞান দেহ-লাবণ্য। আর্টের অনুভূতি সত্য হলে দ্রষ্ঠার মনের ও মুক্তি ঘটে। জড়বাদ ও নেহাৎ প্রয়োজনবাদের যুগে বিজ্ঞানমনস্কতাই আর্টের মূল্যকে অগ্রগন্য করবে এবং মানব সভ্যতার অগ্রযাত্রায় কবিতা আবার প্রয়োজনীয় হয়ে ওঠবে। কবিতায় তা-ই হাসনাইন সাজ্জাদীর বিজ্ঞানবাদ।
এরিস্টটল এখানে সফল। তিনি বস্তুবাদী এবং তিনিই দর্শনের জনক। তার চিন্তার পূর্ণতাই হাসনাইন সাজ্জাদীর বিজ্ঞানবাদ ও বিজ্ঞানকাব্যতত্ত্ব। যদিও তিনি মনে করতেন বিজ্ঞানের বিষয়কে ছন্দের মাধ্যমে লিখলেও তিনি বিজ্ঞানী হিসাবে চিহ্নিত হবেন। কবি হিসাবে তিনি চিহ্নিত হবেন না। হাসনাইন সাজ্জাদী তাই বিজ্ঞানের বিষয় থেকে উপমায় নিয়ে এসে অভূতপূর্ব মিলন রেখা তৈরি করেছেন। তাই তার কবিরা বিজ্ঞান কবি। শুধু বিজ্ঞানী বা শুধু কবি তারা নয় কখনোই। [এরিস্টটলের পোয়েপিটক্স, বা কাব্য নির্মাণকলা দ্রষ্ঠব্য]।
হোরেস প্রথমে ব্যঙ্গ কবিতা লিখলেও দ্বিতীয় কাব্য ধারায় তিনি রাজনৈতিক কবিতায় বিবরণধর্মীতার চর্চা করেছেন। তাতে আবেগের তীব্রতা ছিল। বিজ্ঞান কবিতার সাবলীল ছন্দের সাথে তার সাদৃশ খোঁজ পাওয়া যায়। হোরেসের ‘আ পোয়েটিকা’ কে “কাব্যের শিল্পকলা” বা সাহিত্য নির্মাণ তত্ত্ব বলা হয়। হাসনাইন সাজ্জাদীর “বিজ্ঞান কাব্যতত্ত্ব ও সাবলীল ছন্দ’র সাথে হোরেসের ‘আ পোয়েটিকা’র মিল এখানেই। হোরেস প্রথমেই জীবনের জন্য সাহিত্য বলেছেন। আনন্দদান ও উপযোগ সৃষ্টি বা আনুকূল্য প্রাপ্তির কথাও তিনি বলেছেন। আত্মতৃপ্তিও আনন্দদানে জীবনাযুগকে তিনি বাধ্যতামূলক বলেছেন।
লুঙ্গিনাস’র কাব্যতত্ত্ব ‘ চঊজও ঐুঢ়ংড়ং’ ভাব, আবেগ, শব্দ বাক্য, অলঙ্কার শৈলী ইত্যাদির যথাযথ ব্যবহারের লক্ষ্যে রচিত। ‘সিসিলিয়াস’ নামে এক লেখকের চঊজও ঐুঢ়ংড়ং নামে একটি প্রবন্ধ পড়ে লেখকের সাহিত্য উৎকর্ষতাও সৌন্দর্য সম্পর্কে অসম্পূর্ণতা লক্ষ্য করে লুঙ্গিনাস এ গ্রন্থ লেখেন। ভাব, ভাষা ও নির্মানে চমৎকারিত্ব প্রদর্শনের কথা হাসনাইন সাজ্জাদীর বিজ্ঞান কাব্যতত্ত্বেও আমরা খোঁজে পাই।
উৎকর্ষও মহিমান্বিত কবিতায় লুঙ্গিনাস মহৎ ভাব সৃষ্টির ক্ষমতা, শক্তিশালী এবং প্রেরণা সৃষ্টিকারী আবেগও উদ্দীপনা সৃষ্টির ক্ষমতা, অলঙ্কার সৃষ্টিতে কৃতিত্ব, মহৎ কবি ভাষা সৃষ্টির ক্ষমতা এবং ভাবেশ্বর্য ও সৃষ্টি শৈলীজাত সামগ্রিক আবেদন থাকার ওপর জোর দিয়েছেন। প্রথম দু’টিকে সংগঠন উপাদান হিসাবে সহজাত ও জন্মসূত্রে প্রাপ্ত আর পরের তিনটিকে লুঙ্গিনাস বলেছেন- কলাকৌশলজাত অর্থাৎ অনুশীলন সাপেক্ষ। ভাল করে চর্চা করলে তা আয়ত্বে আসবে। প্লেটোর মতে, সত্য নির্ভর ও সৌন্দর্যের ওপর অনুকরণের মূল্য নির্ধারিত হবে। এরিস্টটল অবশ্য সত্য ও সুন্দরের অনুকরণ নয়, অনুকরণ নিজে সুন্দর হলে তা কুৎসিতের হলেও তার আপত্তি নেই বলে জানিয়েছেন। হাসনাইন সাজ্জাদী এখানে কবিকে সত্য দ্রষ্ঠাও ক্রান্তদর্শী হওয়ার ওপর জোর দিয়েছেন। লুঙ্গিনাসের উৎকর্ষ বা মহিমান্বিত কবিতার জন্য ৫ দফা তাৎপর্যকে বিজ্ঞান কবিতার জন্য নিয়ামক বলে মনে করেন হাসনাইন সাজ্জাদী।
ক. সাহিত্যতত্ত্বের ধারার- প্রাচীনও শুদ্ধতাশ্রয়ী,- বিষয় ও আঙ্গিকে বিশেষ বৈশিষ্ট্য বাংলায় যাকে ধ্রুপদী সাহিত্য বলা হয়ে থাকে। স্থির অঞ্চল, যা কখনো পরিবর্তিত হয়না এমন ধ্রুবপদ সাহিত্যই ক্লাসিক যা কালজয়ী।
নিউক্লাসিসিজম এ ধারায় ঐতিহ্য প্রীতিপ্রবল, হোরেসের ব্যবস্থাপত্র অনুযায়ী ‘প্রিন্সিপাল অব ডেকোরাম’র অনুসরণ, মৌল উৎস হিসাবে সভ্য সমাজের সভ্য মানুষ, নারীকে প্রকৃতির রূপ লাবন্যে তথা প্রেম, দায়িত্ব, শাসনও সেবায় অনন্যতম ব্যক্তিত্বের আদলে ব্যবস্থাপিত করা, প্রতিনিধিত্বশীল সাহিত্য রস সৃষ্টি, রুচিবোধে নান্দনিকতা, মরমে ডুব দিয়ে থেকে ফিলসফি খোঁজা, মানবীয় গুণাবলী অর্জন, প্রাচীন স্থাপত্য রীতির অলঙ্কার বিন্যাস এ ধারায় অন্যতম বৈশিষ্ট্য। তাই আমরা দেখি বিজ্ঞানকাব্যতত্ত্বে নিউক্লাসিজম আরেক্টু পরিশুদ্ধ ভাবে নতুনত্ব লাভ করেছে।
খ. মধ্যযুগের ফরাসী গাঁথাকাব্যের ধারায় আত্ম পন্থীও বিষয়ী প্রধান কাব্যকে রোমান্টিক কাব্য হিসাবে চিহ্নিত করা হয়েছে। আশ্চর্য, অলিক, মিথ্যা, উদ্ভব, কল্পনা, তীব্র অনুভূতি, স্বপ্নময় প্রভৃতির চর্চায় রোমান্টিক কবিতা এগিয়ে চললেও পরবর্তীকালে প্রধানও প্রতিভাবান কবিদের হাতে পড়ে এ বিষয়টি রহস্যময় সৌন্দর্যলোকের আবিষ্কার , অলৌকিক জাতের রসাম্বাদন এবং প্রকৃতির বর্ণালী ব্যঞ্জনায় সমৃদ্ধ হয়। বিজ্ঞান কাব্যে তার চর্চা হবে নিরাসক্ত এবং উপমা উৎপ্রেক্ষাও চিত্রকল্পে যুক্তিগ্রাহ্য বিজ্ঞানময়।
গ. রিয়েলিজম বাংলায় বাস্তববাদ। দর্শন শাস্ত্র থেকে প্রথমে চিত্রকলায় এটির আগমন ঘটেছিল। উনির শতকের প্রথম দিকে ফরাসি দার্শনিক অগাস্টকোৎ ইউরোপের তরঙ্গায়িত সমাজের উপযোগী ও প্রত্যক্ষবাদ দর্শন (অঁমঁংঃ পড়সঃব) যখন উপস্থাপন করলেন তখন নিস্তরঙ্গ ও নিপ্রাণ সমাজের ভিতকে নাড়িয়ে দেয় যুক্তিধর্মী ও বিজ্ঞান ভাবাপন্ন এ দর্শন। এ প্রত্যক্ষবাদ (চঙঝওঞওঠওঝগ) ই সাহিত্যে রিয়েলিজম হিসাবে স্থান করে নেয়। এই সময়ে জার্মান দার্শনিক ফয়েরবাগ (ঋঊটঊজইঅঈ) মানুষকে বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিকোন থেকে বিশ্লেষণ করেন। ফলে অভিজ্ঞতা ও ইন্দ্রানুভূতি জ্ঞানের উৎস হিসাবে বিবেচিত হয়। ফলে শিল্পী ও দার্শনিকগনের চেতনায় জীবন ও জন্য সম্পর্কে একটি নির্মোহভাব ক্রিয়াশীল করে তোলে। ফরার্সী ঔপন্যাসিক ওন’ রেদ্যা বালজ্যাক (১৭৯৯-১৮৫০) তার উপন্যাসের মধ্য দিয়ে সাহিত্যে এ রিয়েলিজমের প্রবর্তন করেন। রিয়েলিজমে বাস্তবতাই মূখ্য। বাস্তব পৃথিবীই শিল্পের ভিত্তি। কল্পনা মূল্য নয়। বিজ্ঞান কবিতায় কবির কাজ স্বপ্ন দেখানো নয়। বাস্তব বলা এবং সামনের সমূহকে দেখা বিজ্ঞান কবির কাজ। এক্ষেত্রে সরাসরি বাস্তবতা বিবৃত না করে জড়বাস্তবকে সাহিত্যের চিন্ময় বাস্তবে পরিণত করে বিজ্ঞান কবিতা লিখতে হয়।
ঘ. ন্যাচারালিজম বা যথাস্থিতবাদ ছিল-প্রকৃতিতে যা কিছু যেভাবে আছে তার যথাযথ উপস্থাপন। সাহিত্যে ন্যাচারালিজমের বাংলা প্রকৃতিবাদ করা হলেও এটা আসলে সাহিত্যে যথাস্থিতবাদ বা বাস্তববাদেরই রকমফের। বিজ্ঞানবাদকে অবশ্য যথাস্থিতবাদ বা বাস্তববাদের রকমফের আমরা বলবো না। তবে তা বলার পেছনে কি কি যুক্তি রয়েছে তা আলোচনা না করে নয়। তার আলোচনা হবে হাসনাইন সাজ্জাদীর বিজ্ঞানকাব্যতত্ত্ব ও সাবলীল ছন্দের আলোকে।
এমিল জোলা (১৮৪০-১৯০২) তার কয়েকজন চিত্রকর বন্ধুর নিকট থেকে প্রথমে এই ন্যাচারালিজমকে আমদানী করেন। রোমান্টিসিজম ও সুরলিয়ালিজমকে প্রতীকি, ভাববাদীও অতিপ্রাকৃত ভেবে ইউরোপের মানুষ সময় প্রত্যাখ্যান করে। তাদের বিশ্বাস ছিল কল্পনা প্রবনতা, স্বপ্নাবিষ্ট ভাবালুতা, যুক্তিহীন বিশৃঙ্খলতা ও দূর্যোধ্যতা মানুষকে বিভ্রান্ত করে। ১৯ শতকে সারা বিশ্বের সমাজ জীবনে দর্শন ও বিজ্ঞানের কারণে যে পরিবর্তন আসে তাতে ন্যাচারালিজম গ্রহণযোগ্যতা লাভ করে। এটা পুরোপুরি ডারউইনের বিবর্তনবাদের ওপর প্রতিষ্ঠিত। জীববিজ্ঞানী ডারউইনের তত্ত্বের ওপর ভিত্তি করে এটি এমন এক সাহিত্য নির্মান কৌশল যাতে নৈর্ব্যক্তিক ও নিরাসক্ত দৃষ্টিতে মানবিক বৃত্তির বৈজ্ঞানিক বিশ্লেষণ পাওয়া যায়।
ঙ. মার্কসিজম বাংলায় যার অর্থ ঘুরপ্যাচ না করে ও মার্কসবাদ বলে ধরে নেয়া হয়। জার্মান দার্শনিক ও সমাজবিজ্ঞানী ড. কার্ল হাইরিশ মার্কস (১৮১৮-১৮৮৩) সমাজ পরিবর্তনের জন্য এ বিপ্লবী মতবাদ উপস্থাপন করেন। জীবনমান পরিবর্তনের জন্য দর্শনের প্রায়োগিক দিকটিকে মার্কসবাদে মূল্য করা হয়েছে। সমাজের যে শ্রেণির মানুষ অর্থেবিত্তে খেয়ে পরে ভাল আছে এবং মানুষকে শোষন করে চলেছে, তাদের ফেলে দেয়া খাবার নিয়ে টানাটানি করে কুকুর ও মানুষ। মানুষ মানুষের সাথে যুদ্ধ করে না। তারা যুদ্ধ করে কুকুরের সাথে। কুকুরের প্রতিযোগী এই মানুষগুলো শ্রেণিহীন বা সর্বহারা। জগতে শ্রেণিবৈষম্য তৈরি করে রেখেছে একদল মানুষ । তারা পূঁজিবাদী। তারা নিজেদের অভিজাত ভাবে। তাদের অধিনে উৎপাদন ব্যবস্থা নিয়ে নেয় তারা, ফলে অন্যেরা তাদের কাছে শ্রম বিক্রয় করতে বাধ্য হয়। এই অবস্থা থেকে বেরিয়ে আসার জন্য ও সকল মানুষের অধিকার সমান করতে কার্ল-মার্কস যে তত্ত্ব দিলেন তার সাহিত্যিক আঙ্গিকই মার্কসীয় শিল্প-সাহিত্য। ১৯১৭ খ্রিষ্ঠাব্দের রুশ বিপ্লবের পর বাংলা সাহিত্যে মার্কসীয় দর্শন বিশেষ দৃষ্টি লাভ করে। এক্ষেত্রে ১৯৮৮ খ্রিষ্ঠাব্দে হাসনাইন সাজ্জাদীর নতুন প্রজম্মের কবিতা শিরোনামে ‘বিজ্ঞান যুগে বিজ্ঞান কবিতা’র আন্দোলন ও তৎপরে ‘বিজ্ঞানকাব্যতত্ত্ব ও সাবলীল ছন্দ’ একটি বৈপ্লবিক ধারা হলেও এখনো তার সে রকম মূল্যায়ন হয়নি!
চ. ফ্রয়েডীয় সাহিত্যতত্ত্ব বা অবদমনবাদ; চিকিৎসক ও মনোবিজ্ঞানী সিগমুন্ড ফ্রয়েডের (১৮৫৬-১৯৩৯) অবদমনবাদ হচ্ছে মানুষ অন্যান্য প্রাণীর মতই স্বাধীন ও স্বেচ্ছাচারি ছিল। শুরুটা একরকমই ছিল। তারপর এল সামাজিক বিধিবিধান। প্রথমে সমাজ, তারপর এল ধর্ম। এল আইনকানুন। আকাঙ্খা থেকে যৌনাকাঙ্খা সবই মানুষ নিয়ন্ত্রণে নিয়ে এল। তবে কোন এক স্তরে তা অবদমিত থেকে যায় অবচেতন বা অচেতন ভাবে মনের কোন এক স্তরে। কাম, ক্রোধ, লোভ, পরশ্রীকাতরতা প্রভৃতি মানুষের জন্মসূত্রে প্রাপ্ত। এটা অন্তরের রূপ। বাহ্যিক রূপ হয়তো একটু পরিশীলিত। শিল্পী-সাহিত্যিকগণ এই তত্ত্ব নিয়েই কাজ করেন। ফ্রয়েডের হাত ধরে এ দিকটি উন্মাচিত আমরা হতে দেখি। তাই এর নাম ফ্রয়েডীয় সাহিত্যতত্ত্ব। এই সাহিত্য তত্ত্বে মানুষের অবচেতন মনকে তোলে আনে। যৌনতাকে জীবনের অংশ বলে বিবেচনা করে। বিজ্ঞান কবিতায় যৌন স্বাধীনতার কথা এখান থেকেই উঠে আসে। ধর্মে কর্মে যৌন স্বাধীনতার কথা বিজ্ঞান কবিতার ১৮ তম কর্মপদ্ধতির মধ্যে হাসনাইন সাজ্জাদীর আলোচনা করেছেন।
ছ. ফেমিনিজমকে নারীবাদ বলে অনুদিত হতে দেখা যায়। উনিশ শতকের শুরুতে এক কল্পিত নারীকে ফরাসি সমাজতন্ত্রী চার্লস ফুরিয়ের এই ঋঊগওঘওঝগ শব্দটির দ্বারা বোঝান । কল্পিত এই নারী প্রতিদ্বন্ধিতায় নয়, পরস্পর সম্প্রীতি নির্ভর থেকে সমাজে পরিবর্তন আনবে। উনিশ শতকের আশির দশকে হুবারটিন অকলাট ‘ফ্রেন্স উইমেন্স সাফ্রেজ সোসাইটি’র প্রতিষ্ঠা করেন। শব্দটি নারী আন্দোলন বা অধিকার বোঝাতে ব্যবহার হয়ে থাকে। এটা পুরুষ বিদ্বেষী কোন মতবাদ নয়। লিঙ্গ বৈষম্য ঘটানোর জন্য পরিকল্পিত চিন্তা। নারীকে জাগিয়ে তুলতে সকল লেখাই এ ধারণার মধ্যে গণ্য হয়। বিজ্ঞান কবিতার একটি ধারায় নারী পুরুষ নয়, মানুষ লিখবে মানুষের জন্য লিখবে -এমন কথা বলা হয়েছে। তবে ব্যক্তি হাসনাইন সাজ্জাদী নারীবাদের চেয়েও বেশি অথার্ৎ শেষ্ঠ্যত্ব বিশ্বাসী বিশশতকের শেষে এসে।
জ. মডার্নিজম বা আধুনিকতাবাদ। যা পরবর্তীকালে আধুনিক বলেই সংক্ষেপিত হয়েছে। তবে তা সাম্প্রতিক অর্থে নয়। কারণ ভিন্ন। তারপর উত্তর আধুনিক বা পোস্ট মডার্নিজম এসেছে। এসেছে বিজ্ঞানবাদ বা সাইন্সইজম। হাসনাইন সাজ্জাদীর হাত ধরে বিজ্ঞানবাদ এবং বিজ্ঞানকাব্যতত্ত্ব উপস্থাপিত হয়েছে।
প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর রেনেসাঁ ও ফরাসি বিপ্লবের ধারাবাহিকতায় পাশ্চাত্যে বড় ধরনের পরিবর্তন ঘটতে থাকে। দৃশ্যত রাজতন্ত্রের পতন, মৈত্রী ও ভ্রাতৃত্বের ভাবনা জোরদার, জাতীয়তাবাদী আদর্শও উদার নৈতিক চেতনার মাধ্যমে মানবতার দুয়ার খুলে যায়। নারী মুক্তি, ধর্মভিত্তিক পরলৌকিক জীবনধারার পরিবর্তে ইহলৌকিক সংশ্লিষ্ট জীবনধারার প্রাধান্যে মানুষ বড় হয়ে গেল। বিজ্ঞানের নানা আবিষ্কার বিদ্যুৎ, টেলিফোন, স্টিম ইঞ্জিন, রেলওয়ে, উড়োজাহাজ, রেডিও, টেলিভিশন, ফ্রিজ প্রভৃতি এলো। ডারউইন নিয়ে এলেন বিবর্তনবাদ। ১৮৫০ খ্রিষ্ঠাব্দে তার ‘অরজিন অব দ্যা স্পেসিজ’ সৃষ্টি তত্ত্বের নতুন ব্যাখ্যা দিলেন। কার্ল মার্কস’র থিয়োরি রাজনীতিতে আছেই। ফ্রয়েডের নতুন তত্ত্ব তোলপাড় করে দিয়ে গেল বিশ্বে। ‘ইন্টারপিটিশন অব ড্রিম’ গ্রন্থটি ফ্রয়েডের বিশ্বখ্যাত হয়ে গেল।
কবি এজরা পাউন্ড ‘নতুন করে কর’ - বা আন্দ্রেজিদ বলে নাড়িয়ে দিলেন সাহিত্যাঙ্গন। ধর্মীয় অনুশাসনের বৃত্ত থেকে বেরিয়ে পড়লো লেখককূল। ভলতেয়ার বলে দিলেন ‘ইহ জাগতিক উপভোগ মানুুষের সুখের উৎস।’ জীবনের অপরিহার্য অঙ্গ হয়ে পড়লো বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির অবদান। সাম্য, মৈত্রীও স্বাধীনতার কথা বললেন আইজ্যাক রুশো। প্রগতির সকল মতও পথ দখল নিল আধুনিকতাবাদের আবরণে। মানব সভ্যতা এগিয়ে গেল। প্রাচীন গ্রিক দর্শনের প্রভাব তথা সত্য ও সুন্দরের ধ্রুপদী এবং মাঙ্গলিক বলে খ্যাত নান্দনিকতা হল অগ্রসরমান, জীবনের মত মৃত্যুকে স্বাভাবিক ভাবে গ্রহণ করে জন্ম নিল নতুন মূল্যবোধ। পাপ, অন্ধকার ও তুচ্ছ বিষয়কে সাহিত্যে বড় করে তোলা হল। শার্ল বোদলেয়ার এ ধারায় প্রচুর লিখলেন। প্রতিশ্রুতি, আনন্দ, প্রাপ্তি, ধ্বংস এমনতর পরিবেশে নিজেদের আবিষ্কার প্রবনতা লক্ষ্য করা গেল। ভালোবাসার বিপরীতে হতাশা, আর সৌন্দর্যের বিপরীত কুৎসিত ইত্যাদিকে আধুনিকতার স্বভাব ভাবা হল। জীবন ও জগতের পালাবদলে ক্রমাগত পরিবর্তন, ব্যক্তির আত্মউন্নয়ন, আত্মবিশ্বাসকে ঘিরে মুক্তির আনন্দ, অবারিত স্বাধীনতার আনন্দ হয়ে উঠলো আধুুনিকতার বিপ্লব।
মডার্নিজম এভাবেই সাংস্কৃতিক আন্দোলন, শিল্প সৃষ্টির আঙ্গিক হয়ে প্রকাশ ভঙ্গিতে একটি নতুন স্টাইল হল। কার্লমাক্স অবশ্য মডার্নিজমকে পুঁজিবাদের পরিণতি বলেছেন। উনিশ শতকের সাহিত্যে নাগরিক প্রকাশভঙ্গি; দেশবিদেশের নানাবিধ বৈজ্ঞানিক, দার্শনিক রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক আন্দোলনের প্রভাবকে ধারণ করার প্রত্যয়; প্রতিষ্ঠিত মূল্যবোধে অবিশ্বাস; জীবনের বহুমাত্রিক টানাপোড়েন বিষাদ, ক্লান্তি, ক্রোধ ইত্যাদিকে অগ্রাধিকার দিয়ে সমাজ পরিবর্তরে অঙ্গীকার ও দৃঢ় আশাবাদী সমৃদ্ধ ছিল আধুনিকতাবাদীদের উপজীব্যকাব্য। পাশাপাশি দূর্বোধ্যতা, জটিল চিন্তাভাবনা, উপমা ও চিত্রকল্পের বহুভাঙ্গনকে গুরুত্ব দেয়া হয়। দ্বৈততা, ও অনির্দিষ্টতাকে বৈশিষ্ট্য করা হল। বৈপরীত্য বা পরস্পর বিরোধী মনোভাবকে মেধাও মননের পরিচয় হিসাবে অগ্রগন্য করা হল। ফলে আধুনিক কবিতা উদ্দেশ্যহীনও দূর্বোধ্য হয়ে পড়লো। তবে স্বাধীনতার অপার মনোভাব সকলের কাছে তত্ত্ব হিসাবে আধুনিকতাবাদকে জনপ্রিয় করে তুললো। কবিতায় টিএস ইলিয়েট, এলিয়েটস, ফ্রস্ট, ওয়াসেল স্টিভেনস, অডেন, রবার্ট গ্রেভস, ডিলান টমাস, টেড হিউজ, সিলভিয়া প্লাঠ প্রমূখ বেশ জনপ্রিয় হলেন। বোদলেয়ারত ছিলেনই। এ ধারাকে বাংলা কাব্যে নিয়ে এলেন বুদ্ধদেব, জীবনানন্দ দাস, অমীয় চক্রবর্তী, সুধীন দত্ত ও বিষ্ণুদে। আধুনিক কবিতার অনেক নেগেটিভ ধারাকে চ্যালেজ্ঞ করে বিজ্ঞান কবিতাকে পজিটিভ করে উপস্থাপন করা হয়েছে। তার পূর্বে পোস্ট মডার্নিজম এসেছে। তার ব্যর্থতাও লক্ষ্য করা গেছে। মডার্নিজমের কুফল হিসাবে কবিতার জনপ্রিয়তা হ্রাস পায়। পাশাপাশি পোস্ট মডার্নিজম গ্রহনযোগ্যতা পায়নি। তাই আশির দশকে হাসনাইন সাজ্জাদীর হাতে বিজ্ঞান কবিতার চর্চা শুরু হয়।
ঝ. পোস্ট মডার্নিজম বা উত্তরাধুনিকতাবাদ প্রথম ব্যবহার হয় ল্যাটিন আমেরিকান কবি ফেদিরিকা দ্যা ওনিস এর দ্বারা তরুণ কবিদের নিয়ে স্প্যানিস ভাষার একটি কাব্য সংকলনের পোস্ট মডার্নিসমো নামকরণে। তবে এর তাত্ত্বিক হিসাবে জাঁ ফ্রাঁসোয়া লিওতোর, জ্যাক দেরিদা, মিশেল ফুকো, রিচার্ড ররোটি, জাঁ বোদ্রিয়ার প্রমূখকে। শুরুতেই এর নামকরন ও উৎস নিয়ে বিতর্ক ও হতাশা পরিলক্ষিত হয়। আধুনিকতাবাদের বিরোধীতায় মানুষের অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগিয়ে নতুন সাংস্কৃতিক আন্দোলন হিসাবে “পোস্ট মডার্নিজম ” কেচিহ্নিত করা হয়। পূর্ববর্তী দার্শনিক ভাবনাও সকল নির্মান কে ভেঙ্গে পূনঃ নির্মান ছিল উত্তর আধুনিকতার মূলে। তাই আধুনিকতার সম্প্রসারিত রূপ হিসাবে উত্তরাধুনিকতাকে তাই সহজেই চিহ্নিত করে ফেলা যায়। যারা মডার্নিজমকে একটি চলমান পদ্ধতি ভেবে থাকেন তারা বলেন, মডার্নিজমের ভেতর থেকেই কেলাসিত হয়ে আসছে পোস্টমডার্নিজম। ফলে ইউরোপের শিল্প বিপ্লব, ফরাসি বিপ্লব, চিনের সাংস্কৃতিক বিপ্লব, বা রাশিয়ার সমাজতান্ত্রীক বিপ্লবের পরও এবং তথ্যপ্রযুক্তির হাত ধরে বিশ্ব নতুন নতুন বাক নিলেও কবিতার বাক বদলে পোস্ট মডার্নিজম তেমন কোন ভূমিকা রাখতে পারেনি। তাই এখানে বিজ্ঞানবাদ বা বিজ্ঞানকাব্যতত্ত্ব জন্ম নেয়। কারণ পোস্টমডার্নিজমকে অস্তিত্বহীন ভাবা হয় মডার্নিজম ছাড়া। মডার্নিজমের ওপর ভিত্তি করে যেখানে পোস্টমডার্নিজম চলছে সেখানে ডিজিটাল বিপ্লবে বা চেতনায় যে চলমান বহুমাত্রিক বিপ্লব তা পোস্টমডার্নিজম গ্রহন করতে পারেনি। তাই ডিজিটাল বিপ্লবকে অবলম্বন করে, জৈবপ্রযুক্তির সাহায্যে চেতনার বৈপ্লবিক বহুমাত্রিকতায় বিজ্ঞানকাব্যতত্ত্ব পোস্টমডার্নিজমের গন্তব্যহীন বিদ্রোহীর চরিত্রকে অধিগ্রহন করে বিজ্ঞানবাদের উপস্থাপিত হল।
এখানে লক্ষনীয় যে, ক. পোস্টমডার্নিজম কেন্দ্র থেকে মুক্ত হয়ে ছোট ছোট সংগ্রামকে উৎসাহিত করে। কিন্তু এ দ্রোহকে একত্রিত হতে দেয়না। ফলে মানুষের বৃহত্তর ঐক্য গড়তে পারেনা পোস্টমডার্নিজম। এখানে বিজ্ঞানবাদ গোটা বিশ্বকে একই আদর্শে একই সংগ্রামে কেন্দ্রীভূত করতে চায়। তাই বিজ্ঞানবাদ তার ঠিক উল্টো।
খ. বিজ্ঞানবাদ একটি পরিপূর্ণ দর্শন। ৬ দফার আলোকে ও ১৮ কর্ম পদ্ধতিতে বিজ্ঞান কাব্যতত্ত্ব উপস্থাপিত হয়েছে। পোস্টমডার্নিজমে কোন যুক্তি মানা হয় না। কোন আদর্শ তাদের নেই। কিন্তু বিজ্ঞানবাদ ও বিজ্ঞানকাব্যতত্ত্ব তা নয়। বিজ্ঞানকাব্যতত্ত্ব কেবলমাত্র আদশিক এবং তা বিবর্তনবাদের আলোকে মানবমুক্তির লক্ষে সমিতিভিত্তিক অর্থব্যবস্থায় নতুন দর্শন।
গ. উত্তরাধুনিকতা পুঁজিবাদের বিশ্বায়ন। তারা তত্ত্বও দেয়না, সত্য ও দেয়না। বিজ্ঞানবাদ পুঁজিবাদ বিরোধী। ধনী-গরীবের ব্যবধান কমিয়ে আনতে চায় বিজ্ঞানবাদ তত্ত্ব এবং নিজস্ব একটি সত্য আছে বিজ্ঞানবাদের।
ঘ. অতীতের সকল কিছুই মন্দভাবে উত্তরাধুনিকতাবাদ। সকল কিছুতেই উত্তরাধুনিকতাবাদের প্রশ্ন ও সন্দেহ। বিজ্ঞানবাদে ঠিক তার উল্টো। অতীতকে রিফর্ম করতে চায় বিজ্ঞানবাদ। একেবারে বাদ দেয়া নয়।
ঙ. বিশ্বায়নবাদের বাস্তবায়নে দালালী করছে উত্তরাধুনিকতাবাদ। অধ্যাপক আবুল কাসেম ফজলুল হকের মতে ‘এর পেছনে কলকাটি নাড়ছে আমেরিকা।’ বিজ্ঞানবাদ পুরো বিশ্বকে- পুঁজিবাদ ও মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের নাগপাশ থেকে মুক্তি দিতে চায়।
চ. উত্তরাধুনিকতাবাদ জাতি, রাষ্ট্র, জাতীয়তাবাদ, জাতীয়তাবোধ ও রাষ্ট্রের সীমানা মানেনা। বিজ্ঞানবাদ নতুন দর্শনের আলোকে নতুন জাতি রিফর্ম করবে, নতুন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা দেবে।
ছ. উত্তরাধুনিকতাবাদীগন লোকসংগীতকে প্রাধান্য দেয়। উচ্চাঙ্গসংগীতকে তারা মানেনা। বিজ্ঞানবাদ শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের বিবোধী নয়। লোকসংগীতের ও তারা বিরোধীতা করে না। তবে বিজ্ঞানসংগীত তারা জন্ম দিতে চায় নতুন সংগীত হিসাবে। যেখানে বিজ্ঞানের উপমা, উৎপ্রেক্ষাও চিত্রকল্প থাকবে। গ্রহ-নক্ষত্রে বসবাসকে উৎসাহিত করবে যে সংগীত।মানুষের অধিকারকে বড়করে বিজ্ঞানসঙ্গীত রচিত হবে।
৩.বিজ্ঞানবাদ ও বিজ্ঞানকাব্যতত্ত্ব; বিজ্ঞানে সকল মানুষ সমান। সকলের অধিকার সমান। চলমান সম্পদকে তাই তিনভাগ করে বিজ্ঞানবাদ সমিতিভিত্তিক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করতে চায়। এটাকে বিজ্ঞানবাদ কল্যান রাষ্ট্র বলে থাকে। বিজ্ঞানবাদ প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে বিজ্ঞান মনস্ক একদল কবি তৈরি করতে চায় বিজ্ঞানবাদ। সে লক্ষ্য থেকেই বিজ্ঞান কাব্যতত্ত্বও সাবলীল ছন্দ’র আবিষ্কার। অতীতের সকল আন্দোলনের বিজ্ঞানমনস্কতা এবং ডিজিটাল বিপ্লবের সুবিধার স্বীকৃতিসহ জাতিকে বিজ্ঞানমনস্ক করার জন্য বিজ্ঞান কাব্য চিন্তার বিকাশ ঘটাতে চায় বিজ্ঞানবাদ।
বিজ্ঞানকাব্যতত্ত্বের ৬দফা হচ্ছে-১. কবিতার উপমা, উৎপ্রেক্ষাও চিত্রকল্পে বিজ্ঞানের আবিষ্কার ও অনাবিষ্কারের প্রয়োগ, ২. ছোট ক্যানভাসে বড় উপমা,৩. রিপোটিং স্টাইলে সাবলীল ছন্দে দাড়ি, কমার কবিতা, ৪. নারী পুরুষ লিঙ্গ বৈষম্য বিরোধী কবিতা যা মানুষের হাতে লেখা ও মানুষের জন্য লেখা, নারী-পুরুষ, সাদা-কালো, ধনী-গরীবের ভেদাভেদ কমিয়ে আনতে চায় বিজ্ঞান কবিতা,৫. বিজ্ঞান সময়কে ধরে রেখে কাব্যচর্চা। সময় ও ডিজিটাল বিপ্লবকে কবিতায় চিত্রায়িত করতে হবে। আধুনিকতাকাল আমাদেরকে দিয়েছে ইলেকট্রিসিটি আর বিজ্ঞান যুগে আমরা পেয়েছি ইলেকট্রনিক্স। যার মাধ্যমে আমরা পিসিতে প্রবেশ করেছি। এখন পার্সোনাল কম্পিউটার ও এনড্রয়েডে আমরা পাচ্ছি ইন্টারনেট। ঘরে বসে সবই করছি নেটের মাধ্যমে। এটাই বিজ্ঞান যুগ, এবং ৬. ধর্ম নিরপেক্ষ কবিতা। আগের সকল ধারাতেই ধর্মকে অস্বীকার করা হয়েছে। বিজ্ঞানবাদে ধর্ম নিরপেক্ষতাকে অবলম্বন করা হয়েছে। ধর্মকে নয়।
আর ১৮ দফা কর্মপদ্ধতির প্রয়োগে রয়েছে ১.বৈশ্বিক উষ্ণতা, বরফগলা, গ্রিনহাউজ এ্যাফেক্ট, কার্বন ডাই-অক্সাইড ও বাতাসে সিসার পরিমান কমানো, ২.ভূমির ক্ষয়রোধ নিঃসরন এবং জলভাগ বৃদ্ধিরোধ, ৩.জনসংখ্যার বিস্ফোরন রোধ ৪ ভৌতিক বিশ্বাস পরিহার, ৫.ধর্মে ধর্মে হানাহানি বন্ধ ৬. ধর্মীয় সম্প্রীতির কবিতা, ৭.ধনীগরীবের ব্যবধান কমিয়ে আনা, ৮. নারী-পুরুষ বৈষম্য রোধ করা, ৯. নারীও শিশুর প্রতি সহিংসতা বন্ধ, ১০.উপমা উৎপ্রেক্ষাও চিত্রকল্পে প্রকৃতির পরিবর্তে যথাসম্ভব বিজ্ঞানের প্রয়োগ, ১১. ধর্মনিরপেক্ষ কবিতা, ১২. যৌন স্বাধীনতাকে উৎসাহিত করা ১৩.বিবর্তনবাদের চর্চাকে উৎসাহিত করা, ১৪.গ্রহ-নক্ষত্রে বসবাসকে জনপ্রিয় করা, ১৫.পরমাণুর যথেচ্ছ ব্যবহার রোধ, ১৬. রাসানিকের ব্যবহার রোধ, ১৭. দেশে দেশে স্বাধীনতা সংগ্রামীদের সমর্থন এবং ১৮. বিজ্ঞানবাদের আলোকে সারা বিশ্বে কল্যাণ রাষ্ট্রপ্রতিষ্ঠার আন্দোলন জোরদার করে কাব্যচর্চা করা।
উপরোক্ত ৬দফা ও ১৮ কর্মপদ্ধতির বিশ্লেষণে প্রতীয়মান হয় যে, বিজ্ঞানবাদ দর্শন এবং বিজ্ঞান কাব্যতত্ত্বের উপস্থাপন ও সাবলীল ছন্দের জন্ম বিজ্ঞান যুগ বিজ্ঞান কবিতার জন্যেই উপযোগী। যা মডার্নিজমও পোস্ট মডার্নিজমের অসারতা প্রমাণ করে একটি সাংস্কৃতিক বিপ্লবের ক্ষেত্র প্রস্তুতের কাব্য আন্দোলন। যার নাম হাসনাইন সাজ্জাদীর বিজ্ঞান কবিতা আন্দোলন। বিজ্ঞান কবিতা সে আন্দোলনেরই ফসল। নতুন ধারার কাব্য নির্মানও নতুন সমাজ প্রতিষ্ঠায় বিজ্ঞানবাদ একটি কল্যাণকর দর্শন। বিজ্ঞানকাব্যতত্ত্ব আগামী দিনের সাহিত্যতত্ত্ব। যা নিয়ে আজকেই আলোচনা করা আবশ্যক।
admin@masudbdtech.blogspot.com
হাসনাইন সাজ্জাদী |
সংস্কৃত সাহিত্যে কবি সত্যদ্রষ্টা ও কবি ক্রান্তদর্শী। কবি যেমন সত্য বলবেন, তেমনি কবি তার জাতিকে আগাম- সতর্ক করবেন। কবি যেহেতু জাতির শিক্ষক। একই সাথে তিনি নেতাও। তাই কবির কাজ বিশ্বের সাম্প্রতিক সমস্যাকে চিহ্নিত করে তার সমাধান বলে দেয়া। কবিতা হবে সময়ের ইতিহাস। কবি মানুষের জন্য লিখবেন, তাই কলাকৈবল্য বাদ নয়, কবির কাজ মানুষকে আধুনিক সময়ের চ্যালেজ্ঞ মোকাবেলায় যোগ্যতর জ্ঞান দান করা।
বিজ্ঞান কবি হাসনাইন সাজ্জাদী তার বিজ্ঞান কাব্যতত্ত্বে ৬ দফার কথা বলেছেন এবং ১৮ দফার কার্য নির্দেশনা দিয়েছেন। তার ৬ দফার বিজ্ঞান কাব্যতত্ত্বের মধ্যে রয়েছে; ‘ক. কবিতার উপমা, উৎপ্রেক্ষা ও চিত্রকল্পে বিজ্ঞানমনস্কতা, খ. ধর্মনিরপেক্ষ কবিতা লেখা। ধর্মীয় হানাহানি ও বিদ্বেষের বাইরে গিয়ে আন্তধর্মীয় সম্প্রীতি প্রতিষ্ঠার জন্য বিজ্ঞান কবিতা রচনা করা। মানুষ কবিতা লিখবে মানুষের জন্য। ধর্মীয় মিথ কিংবা বাক্যাবলী যথা সম্ভব পরিহার করবে। যাতে একটি সর্বজনীন ভাষাও কাব্যদর্শন প্রতিষ্ঠা পায়,
গ. নারী পুরুষ লিঙ্গ- বৈষম্য বিরোধী কবিতা। এতে ধনীগরীব, জাত-পাত এবং সাদা-কালোর ব্যবধান ঘুচিয়ে একটি মানবিক সাহিত্য রচিত হবে,
ঘ. কবিতায় বিজ্ঞান সময়কে ধারন করা। কবিতা যেহেতু সময়কে ধরে রাখার তান, তাই বিজ্ঞান কবিতা হবে সময়ের ইতিহাস। সময়ের সমস্যা চিহ্নিত করে এর সমাধান থাকবে কবিতায়। যেমন বরফগলা রোধ, জনসংখ্যার বিস্ফোরণ রোধ পরমাণুর যথেচ্ছ ব্যবহার রোধ, খাদ্যে রাসায়নিকের ব্যবহার বন্ধ, নারীও শিশুর প্রতি সহিংসতা বন্ধ, ধনী-গরীবের ব্যবধান কমিয়ে আনা, পরিবেশ বিপর্যয়রোধ, বিজ্ঞানের সুফলও কুফল নিয়ে আলোচনা, ধর্মীয় হানাহানি বন্ধ, বিজ্ঞান চিন্তার প্রসার, ভাববাদকে নিরুৎসাহিত্য করা এবং বিবর্তনবাদকে মানুষের সামনে সহজ করে তুলে ধরা বিজ্ঞান সময়ের চ্যালেঞ্জ।
ঙ. রিপোর্টিং স্টাইলে সাবলীল ছন্দে দাড়ি, কমার প্রয়োগে কবিতা। যাতে বাক্যের মধ্যে অর্থ পরিষ্কার হয়ে যায়। কবিতার ভাব, ভাষাও গাঁথুনিতে গুরুত্ত্ব প্রদান করা। বাণীতে সাবলীল থাকা। সংস্কৃত ছন্দকে পরিহার করা। বাংলার আদি ছন্দ ধামালী, মাল ঝাঁপ, পয়ার ও লাচারীর মধ্যে থাকা। এক কথায় কথ্য ভাষায় মনের কথাকে সহজ করে কবিতায় বাণীবদ্ধ করা। যাতে একটি ম্যাসেজ থাকবে। থাকবে চমৎকারিত্ব। এবং
চ. ছোট আঙ্গিকে বড় উপমার কবিতা লেখা। প্রতিচ্য ও পাশ্চাত্য আজকাল ছোট কবিতা লেখা হচ্ছে। প্রতিচ্যের জাপান কবিতার ভূমিকা হিসাবে লেখা হত তিনছত্র। কাল ক্রমে তাই হাইকু নামে কবিতায় স্থান লাভ করেছে। প্রাচ্যে আগেই রুবাইয়াত লেখা হত। পাশ্চাত্যে বিশেষ করে আমেরিকায় এখন থ্রি-লাইনার, ফোর-লাইনার কবিতা লেখা হচ্ছে। যা হাইকু এবং রুবাইয়াত এরই নতুন প্রতিস্থাপন বলা যায়। এক কথায় সময় বাঁচানো এখন বড় কাজ হয়ে পড়েছে। কলা পাতার উপমাকে আমরা যত ছোট বুঝি, আকাশ রঙ বললে আর ছোট থাকে না। উপমা তখন অনেক বড় হয়ে যায়। এটাই ছোট ক্যানভাসে বড় উপমার কবিতা রচনা।
এখন আমাদের বিবেচ্য বিষয় হাসনাইন সাজ্জাদীর এ কাব্য-তত্ত্বকে পাশ্চাত্য সাহিত্যতত্ত্ব ও সাহিত্য সমালোচনা পদ্ধতির আলোকে উৎরিয়ে নেয়া যায় কি -না?
আসুন সে আলোচনার দিকেই আলোকপাত করি; সক্রেটিসের ছাত্র হিসাবে প্লেটো নাম করলেও তার নিজস্ব দর্শন আজ বিশ্ব জোড়া। আবার তিনি এরিস্টটলর শিক্ষক ও বটে। ছোট বেলায় তিনি সক্রেটিস ভাবুকও কল্পনাপ্রবন হলেও নিজ বাসভূমিকে আদর্শ রাষ্ট্র হিসাবে গড়ে তোলার স্বপ্ন তার মধ্যে তরুণ বয়স থেকেই ছিল। তার সূক্ষ্ম যুক্তিবাদিতার সাথে দৈব বাণীর এক কবিত্মময় দ্বীপ্তির কথা বলেছেন কবি শেলী। তার ‘রিপাবলিক’ গ্রন্থের তৃতীয়াংশে কবি ও কাব্যের নিয়ন্ত্রন নিয়ে যে ধারণা মিলে তাতে কবির ভাববাদীতাকে অম্লান করে দেয়। শিল্পের নান্দনিকতাকে প্লেটো গুরুত্ব দেন। এক কথায় কলাকৈবল্যবাদ তার মূলচিন্তা যেখানে জীবন থেকে নান্দনিকতা নিয়ে কাব্যের মূল্য উপজীব্য করা হয়। হাসনাইন সাজ্জাদীর কাব্যতত্ত্বে এটা সম্পূর্ণ বিপরীত। তার মতে, শিল্প থেকে জীবনবোধ তৈরী হবে। তাই কবিকে আগে বিজ্ঞানমনস্ক হতে হবে। তাকে ভাববাদ পরিহার করে মার্কসিজমে আদলে জীবনের জন্য শিল্পকে ভাবতে হবে।
লেনিন বলেছেন; সাহিত্য ও সংস্কৃতি চর্চাকে যারা শ্রেণী নিরপেক্ষ বলে কলাকৈবল্যবাদ প্রচার করে তারা নির্মম ভ- ব্যাতিত আর কিছু নয়। তাই যারা এক্ষেত্রে কলাকৈবল্যবাদের কথা বলে তারা আসলে শোষক শ্রেণীর সাহিত্য-সংস্কৃতি, তাদের কাব্যচর্চা ইত্যাদির সঠিক শ্রেণী চরিত্রকে শোষিত শ্রেণীর চোখের আড়াল করার উদ্দেশ্যই তা বলে থাকে (সাম্প্রতিক বিবেচনা, পৃষ্ঠা-৪৭, আহমদ ছফা)। হাসনাইন সাজ্জাদীর মতে, আর্ট ও বিজ্ঞানে কোন পার্থক্য থাকেনা যদি শিল্পী বিজ্ঞান মনস্ক হন। আর্ট অর্থ সৃষ্টি, রূপায়ন। রূপ সৃষ্টির সহায়তার জন্য যে পদ্ধতির অনুসরণ করা হয় তাতে বিজ্ঞান চিন্তা থাকতে হবে। শিল্পের অংশগত সৌন্দর্য্য যদি জীবনবোধ তৈরি করতে না পারে তবে তা কিসের শিল্প, কার শিল্প? এটা তার কাব্যদর্শন। সৌন্দর্য সুষমা সৃষ্টির দ্বারা মানস দ্বীপ্তির লাবন্য বের করে আনতে হবে। সুষম, সুন্দরও সঙ্গতিপূর্ণ- রূপসৃষ্টি করাই বিজ্ঞান কবিতার বৈশিষ্ট্য। আর্ট কর লাইফ রূপে আত্মপ্রকাশ তখনই ঘটবে যখন রূপাতীতের ব্যাঞ্জনায় যথাবহিত শব্দ চয়ন ও সাবলীল ছন্দের রীতিকে গ্রহণ করা হবে। কবিতা শিল্পের বিজ্ঞান ভূমি এখানেই প্রাজ্বল্যমান। চিত্রকর তুলির লিখনে দূরত্ব বা সন্নিকট বুঝানোর জন্য যে- নির্দ্দেশানুযায়ী রেখা অভয়ন করবেন সেখানেও চিত্রকলার বিজ্ঞান থাকবে হয়তো, কিন্তু সৃষ্টি নিয়ামক পদ্ধতির বিজ্ঞানই কবিতার বিজ্ঞান হবে না। কবিতার বিজ্ঞান বলতে বিবর্তনবাদকে অনুকরণ ও সময়ের দাবীকে অনুসরণে রাখতে হবে। বিবর্তন বাদের অনুকরণও সময়ের চিত্র ধারন ব্যতিত বিজ্ঞান কবিতা হয় না। এখানে ভাববাদ ও অধ্যাত্মবাদের সংমিশ্রনে প্লেটোর কাব্যতত্ত্ব বিজ্ঞান যুগের মাপকাটিতে প্রজ্ঞা দৃষ্টির অতীত। লেখক কেবল নিজের যুগের কথা ভাবলে তা কালজয়ী হয়না। চিন্তা হিসাবে প্লেটোর রিপাবলিক ও কাব্যতত্ত্ব স্বপ্নের ফোয়ারা ছিল কিন্তু তার কাব্যতত্ত্ব নিজের যুগের ভাববাদে যাপিত হয়ে পড়াতে এখানে অনুসরণ ও অনুকরণের যোগ্যতা হারিয়ে ফেলছে বলে কবি হাসনাইন সাজ্জাদী মনে করেন। যুগ মানস থেকে যুগ অতীতের অনুসরণে অনাগত চিরন্তনকে খুঁজে নেয়ার ওপর তাকে জোর দিতে দেখা যায়। ওয়ার্ডস্ওয়ার্থের অষ্টাদশ এলিজাবেথীয় হয়েও কালাতীত জীবন মহিমার রূপ খোঁজা এমন কি মধুসুদনের মেঘনাদবধ কাব্যের নিয়তি-নিপীড়িত দূর্বল মানবত্মার অপরাজেয় মহীমার কীর্ন্তন শিল্প- শ্রেষ্ঠত্বেরই নিয়ামক ছিল।
এককথায় কাব্যে বিজ্ঞান-ললিতকলার ধরনধারন ও অভিব্যঞ্জনার প্রতিফলনই বিজ্ঞান দেহ-লাবণ্য। আর্টের অনুভূতি সত্য হলে দ্রষ্ঠার মনের ও মুক্তি ঘটে। জড়বাদ ও নেহাৎ প্রয়োজনবাদের যুগে বিজ্ঞানমনস্কতাই আর্টের মূল্যকে অগ্রগন্য করবে এবং মানব সভ্যতার অগ্রযাত্রায় কবিতা আবার প্রয়োজনীয় হয়ে ওঠবে। কবিতায় তা-ই হাসনাইন সাজ্জাদীর বিজ্ঞানবাদ।
এরিস্টটল এখানে সফল। তিনি বস্তুবাদী এবং তিনিই দর্শনের জনক। তার চিন্তার পূর্ণতাই হাসনাইন সাজ্জাদীর বিজ্ঞানবাদ ও বিজ্ঞানকাব্যতত্ত্ব। যদিও তিনি মনে করতেন বিজ্ঞানের বিষয়কে ছন্দের মাধ্যমে লিখলেও তিনি বিজ্ঞানী হিসাবে চিহ্নিত হবেন। কবি হিসাবে তিনি চিহ্নিত হবেন না। হাসনাইন সাজ্জাদী তাই বিজ্ঞানের বিষয় থেকে উপমায় নিয়ে এসে অভূতপূর্ব মিলন রেখা তৈরি করেছেন। তাই তার কবিরা বিজ্ঞান কবি। শুধু বিজ্ঞানী বা শুধু কবি তারা নয় কখনোই। [এরিস্টটলের পোয়েপিটক্স, বা কাব্য নির্মাণকলা দ্রষ্ঠব্য]।
হোরেস প্রথমে ব্যঙ্গ কবিতা লিখলেও দ্বিতীয় কাব্য ধারায় তিনি রাজনৈতিক কবিতায় বিবরণধর্মীতার চর্চা করেছেন। তাতে আবেগের তীব্রতা ছিল। বিজ্ঞান কবিতার সাবলীল ছন্দের সাথে তার সাদৃশ খোঁজ পাওয়া যায়। হোরেসের ‘আ পোয়েটিকা’ কে “কাব্যের শিল্পকলা” বা সাহিত্য নির্মাণ তত্ত্ব বলা হয়। হাসনাইন সাজ্জাদীর “বিজ্ঞান কাব্যতত্ত্ব ও সাবলীল ছন্দ’র সাথে হোরেসের ‘আ পোয়েটিকা’র মিল এখানেই। হোরেস প্রথমেই জীবনের জন্য সাহিত্য বলেছেন। আনন্দদান ও উপযোগ সৃষ্টি বা আনুকূল্য প্রাপ্তির কথাও তিনি বলেছেন। আত্মতৃপ্তিও আনন্দদানে জীবনাযুগকে তিনি বাধ্যতামূলক বলেছেন।
লুঙ্গিনাস’র কাব্যতত্ত্ব ‘ চঊজও ঐুঢ়ংড়ং’ ভাব, আবেগ, শব্দ বাক্য, অলঙ্কার শৈলী ইত্যাদির যথাযথ ব্যবহারের লক্ষ্যে রচিত। ‘সিসিলিয়াস’ নামে এক লেখকের চঊজও ঐুঢ়ংড়ং নামে একটি প্রবন্ধ পড়ে লেখকের সাহিত্য উৎকর্ষতাও সৌন্দর্য সম্পর্কে অসম্পূর্ণতা লক্ষ্য করে লুঙ্গিনাস এ গ্রন্থ লেখেন। ভাব, ভাষা ও নির্মানে চমৎকারিত্ব প্রদর্শনের কথা হাসনাইন সাজ্জাদীর বিজ্ঞান কাব্যতত্ত্বেও আমরা খোঁজে পাই।
উৎকর্ষও মহিমান্বিত কবিতায় লুঙ্গিনাস মহৎ ভাব সৃষ্টির ক্ষমতা, শক্তিশালী এবং প্রেরণা সৃষ্টিকারী আবেগও উদ্দীপনা সৃষ্টির ক্ষমতা, অলঙ্কার সৃষ্টিতে কৃতিত্ব, মহৎ কবি ভাষা সৃষ্টির ক্ষমতা এবং ভাবেশ্বর্য ও সৃষ্টি শৈলীজাত সামগ্রিক আবেদন থাকার ওপর জোর দিয়েছেন। প্রথম দু’টিকে সংগঠন উপাদান হিসাবে সহজাত ও জন্মসূত্রে প্রাপ্ত আর পরের তিনটিকে লুঙ্গিনাস বলেছেন- কলাকৌশলজাত অর্থাৎ অনুশীলন সাপেক্ষ। ভাল করে চর্চা করলে তা আয়ত্বে আসবে। প্লেটোর মতে, সত্য নির্ভর ও সৌন্দর্যের ওপর অনুকরণের মূল্য নির্ধারিত হবে। এরিস্টটল অবশ্য সত্য ও সুন্দরের অনুকরণ নয়, অনুকরণ নিজে সুন্দর হলে তা কুৎসিতের হলেও তার আপত্তি নেই বলে জানিয়েছেন। হাসনাইন সাজ্জাদী এখানে কবিকে সত্য দ্রষ্ঠাও ক্রান্তদর্শী হওয়ার ওপর জোর দিয়েছেন। লুঙ্গিনাসের উৎকর্ষ বা মহিমান্বিত কবিতার জন্য ৫ দফা তাৎপর্যকে বিজ্ঞান কবিতার জন্য নিয়ামক বলে মনে করেন হাসনাইন সাজ্জাদী।
ক. সাহিত্যতত্ত্বের ধারার- প্রাচীনও শুদ্ধতাশ্রয়ী,- বিষয় ও আঙ্গিকে বিশেষ বৈশিষ্ট্য বাংলায় যাকে ধ্রুপদী সাহিত্য বলা হয়ে থাকে। স্থির অঞ্চল, যা কখনো পরিবর্তিত হয়না এমন ধ্রুবপদ সাহিত্যই ক্লাসিক যা কালজয়ী।
নিউক্লাসিসিজম এ ধারায় ঐতিহ্য প্রীতিপ্রবল, হোরেসের ব্যবস্থাপত্র অনুযায়ী ‘প্রিন্সিপাল অব ডেকোরাম’র অনুসরণ, মৌল উৎস হিসাবে সভ্য সমাজের সভ্য মানুষ, নারীকে প্রকৃতির রূপ লাবন্যে তথা প্রেম, দায়িত্ব, শাসনও সেবায় অনন্যতম ব্যক্তিত্বের আদলে ব্যবস্থাপিত করা, প্রতিনিধিত্বশীল সাহিত্য রস সৃষ্টি, রুচিবোধে নান্দনিকতা, মরমে ডুব দিয়ে থেকে ফিলসফি খোঁজা, মানবীয় গুণাবলী অর্জন, প্রাচীন স্থাপত্য রীতির অলঙ্কার বিন্যাস এ ধারায় অন্যতম বৈশিষ্ট্য। তাই আমরা দেখি বিজ্ঞানকাব্যতত্ত্বে নিউক্লাসিজম আরেক্টু পরিশুদ্ধ ভাবে নতুনত্ব লাভ করেছে।
খ. মধ্যযুগের ফরাসী গাঁথাকাব্যের ধারায় আত্ম পন্থীও বিষয়ী প্রধান কাব্যকে রোমান্টিক কাব্য হিসাবে চিহ্নিত করা হয়েছে। আশ্চর্য, অলিক, মিথ্যা, উদ্ভব, কল্পনা, তীব্র অনুভূতি, স্বপ্নময় প্রভৃতির চর্চায় রোমান্টিক কবিতা এগিয়ে চললেও পরবর্তীকালে প্রধানও প্রতিভাবান কবিদের হাতে পড়ে এ বিষয়টি রহস্যময় সৌন্দর্যলোকের আবিষ্কার , অলৌকিক জাতের রসাম্বাদন এবং প্রকৃতির বর্ণালী ব্যঞ্জনায় সমৃদ্ধ হয়। বিজ্ঞান কাব্যে তার চর্চা হবে নিরাসক্ত এবং উপমা উৎপ্রেক্ষাও চিত্রকল্পে যুক্তিগ্রাহ্য বিজ্ঞানময়।
গ. রিয়েলিজম বাংলায় বাস্তববাদ। দর্শন শাস্ত্র থেকে প্রথমে চিত্রকলায় এটির আগমন ঘটেছিল। উনির শতকের প্রথম দিকে ফরাসি দার্শনিক অগাস্টকোৎ ইউরোপের তরঙ্গায়িত সমাজের উপযোগী ও প্রত্যক্ষবাদ দর্শন (অঁমঁংঃ পড়সঃব) যখন উপস্থাপন করলেন তখন নিস্তরঙ্গ ও নিপ্রাণ সমাজের ভিতকে নাড়িয়ে দেয় যুক্তিধর্মী ও বিজ্ঞান ভাবাপন্ন এ দর্শন। এ প্রত্যক্ষবাদ (চঙঝওঞওঠওঝগ) ই সাহিত্যে রিয়েলিজম হিসাবে স্থান করে নেয়। এই সময়ে জার্মান দার্শনিক ফয়েরবাগ (ঋঊটঊজইঅঈ) মানুষকে বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিকোন থেকে বিশ্লেষণ করেন। ফলে অভিজ্ঞতা ও ইন্দ্রানুভূতি জ্ঞানের উৎস হিসাবে বিবেচিত হয়। ফলে শিল্পী ও দার্শনিকগনের চেতনায় জীবন ও জন্য সম্পর্কে একটি নির্মোহভাব ক্রিয়াশীল করে তোলে। ফরার্সী ঔপন্যাসিক ওন’ রেদ্যা বালজ্যাক (১৭৯৯-১৮৫০) তার উপন্যাসের মধ্য দিয়ে সাহিত্যে এ রিয়েলিজমের প্রবর্তন করেন। রিয়েলিজমে বাস্তবতাই মূখ্য। বাস্তব পৃথিবীই শিল্পের ভিত্তি। কল্পনা মূল্য নয়। বিজ্ঞান কবিতায় কবির কাজ স্বপ্ন দেখানো নয়। বাস্তব বলা এবং সামনের সমূহকে দেখা বিজ্ঞান কবির কাজ। এক্ষেত্রে সরাসরি বাস্তবতা বিবৃত না করে জড়বাস্তবকে সাহিত্যের চিন্ময় বাস্তবে পরিণত করে বিজ্ঞান কবিতা লিখতে হয়।
ঘ. ন্যাচারালিজম বা যথাস্থিতবাদ ছিল-প্রকৃতিতে যা কিছু যেভাবে আছে তার যথাযথ উপস্থাপন। সাহিত্যে ন্যাচারালিজমের বাংলা প্রকৃতিবাদ করা হলেও এটা আসলে সাহিত্যে যথাস্থিতবাদ বা বাস্তববাদেরই রকমফের। বিজ্ঞানবাদকে অবশ্য যথাস্থিতবাদ বা বাস্তববাদের রকমফের আমরা বলবো না। তবে তা বলার পেছনে কি কি যুক্তি রয়েছে তা আলোচনা না করে নয়। তার আলোচনা হবে হাসনাইন সাজ্জাদীর বিজ্ঞানকাব্যতত্ত্ব ও সাবলীল ছন্দের আলোকে।
এমিল জোলা (১৮৪০-১৯০২) তার কয়েকজন চিত্রকর বন্ধুর নিকট থেকে প্রথমে এই ন্যাচারালিজমকে আমদানী করেন। রোমান্টিসিজম ও সুরলিয়ালিজমকে প্রতীকি, ভাববাদীও অতিপ্রাকৃত ভেবে ইউরোপের মানুষ সময় প্রত্যাখ্যান করে। তাদের বিশ্বাস ছিল কল্পনা প্রবনতা, স্বপ্নাবিষ্ট ভাবালুতা, যুক্তিহীন বিশৃঙ্খলতা ও দূর্যোধ্যতা মানুষকে বিভ্রান্ত করে। ১৯ শতকে সারা বিশ্বের সমাজ জীবনে দর্শন ও বিজ্ঞানের কারণে যে পরিবর্তন আসে তাতে ন্যাচারালিজম গ্রহণযোগ্যতা লাভ করে। এটা পুরোপুরি ডারউইনের বিবর্তনবাদের ওপর প্রতিষ্ঠিত। জীববিজ্ঞানী ডারউইনের তত্ত্বের ওপর ভিত্তি করে এটি এমন এক সাহিত্য নির্মান কৌশল যাতে নৈর্ব্যক্তিক ও নিরাসক্ত দৃষ্টিতে মানবিক বৃত্তির বৈজ্ঞানিক বিশ্লেষণ পাওয়া যায়।
ঙ. মার্কসিজম বাংলায় যার অর্থ ঘুরপ্যাচ না করে ও মার্কসবাদ বলে ধরে নেয়া হয়। জার্মান দার্শনিক ও সমাজবিজ্ঞানী ড. কার্ল হাইরিশ মার্কস (১৮১৮-১৮৮৩) সমাজ পরিবর্তনের জন্য এ বিপ্লবী মতবাদ উপস্থাপন করেন। জীবনমান পরিবর্তনের জন্য দর্শনের প্রায়োগিক দিকটিকে মার্কসবাদে মূল্য করা হয়েছে। সমাজের যে শ্রেণির মানুষ অর্থেবিত্তে খেয়ে পরে ভাল আছে এবং মানুষকে শোষন করে চলেছে, তাদের ফেলে দেয়া খাবার নিয়ে টানাটানি করে কুকুর ও মানুষ। মানুষ মানুষের সাথে যুদ্ধ করে না। তারা যুদ্ধ করে কুকুরের সাথে। কুকুরের প্রতিযোগী এই মানুষগুলো শ্রেণিহীন বা সর্বহারা। জগতে শ্রেণিবৈষম্য তৈরি করে রেখেছে একদল মানুষ । তারা পূঁজিবাদী। তারা নিজেদের অভিজাত ভাবে। তাদের অধিনে উৎপাদন ব্যবস্থা নিয়ে নেয় তারা, ফলে অন্যেরা তাদের কাছে শ্রম বিক্রয় করতে বাধ্য হয়। এই অবস্থা থেকে বেরিয়ে আসার জন্য ও সকল মানুষের অধিকার সমান করতে কার্ল-মার্কস যে তত্ত্ব দিলেন তার সাহিত্যিক আঙ্গিকই মার্কসীয় শিল্প-সাহিত্য। ১৯১৭ খ্রিষ্ঠাব্দের রুশ বিপ্লবের পর বাংলা সাহিত্যে মার্কসীয় দর্শন বিশেষ দৃষ্টি লাভ করে। এক্ষেত্রে ১৯৮৮ খ্রিষ্ঠাব্দে হাসনাইন সাজ্জাদীর নতুন প্রজম্মের কবিতা শিরোনামে ‘বিজ্ঞান যুগে বিজ্ঞান কবিতা’র আন্দোলন ও তৎপরে ‘বিজ্ঞানকাব্যতত্ত্ব ও সাবলীল ছন্দ’ একটি বৈপ্লবিক ধারা হলেও এখনো তার সে রকম মূল্যায়ন হয়নি!
চ. ফ্রয়েডীয় সাহিত্যতত্ত্ব বা অবদমনবাদ; চিকিৎসক ও মনোবিজ্ঞানী সিগমুন্ড ফ্রয়েডের (১৮৫৬-১৯৩৯) অবদমনবাদ হচ্ছে মানুষ অন্যান্য প্রাণীর মতই স্বাধীন ও স্বেচ্ছাচারি ছিল। শুরুটা একরকমই ছিল। তারপর এল সামাজিক বিধিবিধান। প্রথমে সমাজ, তারপর এল ধর্ম। এল আইনকানুন। আকাঙ্খা থেকে যৌনাকাঙ্খা সবই মানুষ নিয়ন্ত্রণে নিয়ে এল। তবে কোন এক স্তরে তা অবদমিত থেকে যায় অবচেতন বা অচেতন ভাবে মনের কোন এক স্তরে। কাম, ক্রোধ, লোভ, পরশ্রীকাতরতা প্রভৃতি মানুষের জন্মসূত্রে প্রাপ্ত। এটা অন্তরের রূপ। বাহ্যিক রূপ হয়তো একটু পরিশীলিত। শিল্পী-সাহিত্যিকগণ এই তত্ত্ব নিয়েই কাজ করেন। ফ্রয়েডের হাত ধরে এ দিকটি উন্মাচিত আমরা হতে দেখি। তাই এর নাম ফ্রয়েডীয় সাহিত্যতত্ত্ব। এই সাহিত্য তত্ত্বে মানুষের অবচেতন মনকে তোলে আনে। যৌনতাকে জীবনের অংশ বলে বিবেচনা করে। বিজ্ঞান কবিতায় যৌন স্বাধীনতার কথা এখান থেকেই উঠে আসে। ধর্মে কর্মে যৌন স্বাধীনতার কথা বিজ্ঞান কবিতার ১৮ তম কর্মপদ্ধতির মধ্যে হাসনাইন সাজ্জাদীর আলোচনা করেছেন।
ছ. ফেমিনিজমকে নারীবাদ বলে অনুদিত হতে দেখা যায়। উনিশ শতকের শুরুতে এক কল্পিত নারীকে ফরাসি সমাজতন্ত্রী চার্লস ফুরিয়ের এই ঋঊগওঘওঝগ শব্দটির দ্বারা বোঝান । কল্পিত এই নারী প্রতিদ্বন্ধিতায় নয়, পরস্পর সম্প্রীতি নির্ভর থেকে সমাজে পরিবর্তন আনবে। উনিশ শতকের আশির দশকে হুবারটিন অকলাট ‘ফ্রেন্স উইমেন্স সাফ্রেজ সোসাইটি’র প্রতিষ্ঠা করেন। শব্দটি নারী আন্দোলন বা অধিকার বোঝাতে ব্যবহার হয়ে থাকে। এটা পুরুষ বিদ্বেষী কোন মতবাদ নয়। লিঙ্গ বৈষম্য ঘটানোর জন্য পরিকল্পিত চিন্তা। নারীকে জাগিয়ে তুলতে সকল লেখাই এ ধারণার মধ্যে গণ্য হয়। বিজ্ঞান কবিতার একটি ধারায় নারী পুরুষ নয়, মানুষ লিখবে মানুষের জন্য লিখবে -এমন কথা বলা হয়েছে। তবে ব্যক্তি হাসনাইন সাজ্জাদী নারীবাদের চেয়েও বেশি অথার্ৎ শেষ্ঠ্যত্ব বিশ্বাসী বিশশতকের শেষে এসে।
জ. মডার্নিজম বা আধুনিকতাবাদ। যা পরবর্তীকালে আধুনিক বলেই সংক্ষেপিত হয়েছে। তবে তা সাম্প্রতিক অর্থে নয়। কারণ ভিন্ন। তারপর উত্তর আধুনিক বা পোস্ট মডার্নিজম এসেছে। এসেছে বিজ্ঞানবাদ বা সাইন্সইজম। হাসনাইন সাজ্জাদীর হাত ধরে বিজ্ঞানবাদ এবং বিজ্ঞানকাব্যতত্ত্ব উপস্থাপিত হয়েছে।
প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর রেনেসাঁ ও ফরাসি বিপ্লবের ধারাবাহিকতায় পাশ্চাত্যে বড় ধরনের পরিবর্তন ঘটতে থাকে। দৃশ্যত রাজতন্ত্রের পতন, মৈত্রী ও ভ্রাতৃত্বের ভাবনা জোরদার, জাতীয়তাবাদী আদর্শও উদার নৈতিক চেতনার মাধ্যমে মানবতার দুয়ার খুলে যায়। নারী মুক্তি, ধর্মভিত্তিক পরলৌকিক জীবনধারার পরিবর্তে ইহলৌকিক সংশ্লিষ্ট জীবনধারার প্রাধান্যে মানুষ বড় হয়ে গেল। বিজ্ঞানের নানা আবিষ্কার বিদ্যুৎ, টেলিফোন, স্টিম ইঞ্জিন, রেলওয়ে, উড়োজাহাজ, রেডিও, টেলিভিশন, ফ্রিজ প্রভৃতি এলো। ডারউইন নিয়ে এলেন বিবর্তনবাদ। ১৮৫০ খ্রিষ্ঠাব্দে তার ‘অরজিন অব দ্যা স্পেসিজ’ সৃষ্টি তত্ত্বের নতুন ব্যাখ্যা দিলেন। কার্ল মার্কস’র থিয়োরি রাজনীতিতে আছেই। ফ্রয়েডের নতুন তত্ত্ব তোলপাড় করে দিয়ে গেল বিশ্বে। ‘ইন্টারপিটিশন অব ড্রিম’ গ্রন্থটি ফ্রয়েডের বিশ্বখ্যাত হয়ে গেল।
কবি এজরা পাউন্ড ‘নতুন করে কর’ - বা আন্দ্রেজিদ বলে নাড়িয়ে দিলেন সাহিত্যাঙ্গন। ধর্মীয় অনুশাসনের বৃত্ত থেকে বেরিয়ে পড়লো লেখককূল। ভলতেয়ার বলে দিলেন ‘ইহ জাগতিক উপভোগ মানুুষের সুখের উৎস।’ জীবনের অপরিহার্য অঙ্গ হয়ে পড়লো বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির অবদান। সাম্য, মৈত্রীও স্বাধীনতার কথা বললেন আইজ্যাক রুশো। প্রগতির সকল মতও পথ দখল নিল আধুনিকতাবাদের আবরণে। মানব সভ্যতা এগিয়ে গেল। প্রাচীন গ্রিক দর্শনের প্রভাব তথা সত্য ও সুন্দরের ধ্রুপদী এবং মাঙ্গলিক বলে খ্যাত নান্দনিকতা হল অগ্রসরমান, জীবনের মত মৃত্যুকে স্বাভাবিক ভাবে গ্রহণ করে জন্ম নিল নতুন মূল্যবোধ। পাপ, অন্ধকার ও তুচ্ছ বিষয়কে সাহিত্যে বড় করে তোলা হল। শার্ল বোদলেয়ার এ ধারায় প্রচুর লিখলেন। প্রতিশ্রুতি, আনন্দ, প্রাপ্তি, ধ্বংস এমনতর পরিবেশে নিজেদের আবিষ্কার প্রবনতা লক্ষ্য করা গেল। ভালোবাসার বিপরীতে হতাশা, আর সৌন্দর্যের বিপরীত কুৎসিত ইত্যাদিকে আধুনিকতার স্বভাব ভাবা হল। জীবন ও জগতের পালাবদলে ক্রমাগত পরিবর্তন, ব্যক্তির আত্মউন্নয়ন, আত্মবিশ্বাসকে ঘিরে মুক্তির আনন্দ, অবারিত স্বাধীনতার আনন্দ হয়ে উঠলো আধুুনিকতার বিপ্লব।
মডার্নিজম এভাবেই সাংস্কৃতিক আন্দোলন, শিল্প সৃষ্টির আঙ্গিক হয়ে প্রকাশ ভঙ্গিতে একটি নতুন স্টাইল হল। কার্লমাক্স অবশ্য মডার্নিজমকে পুঁজিবাদের পরিণতি বলেছেন। উনিশ শতকের সাহিত্যে নাগরিক প্রকাশভঙ্গি; দেশবিদেশের নানাবিধ বৈজ্ঞানিক, দার্শনিক রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক আন্দোলনের প্রভাবকে ধারণ করার প্রত্যয়; প্রতিষ্ঠিত মূল্যবোধে অবিশ্বাস; জীবনের বহুমাত্রিক টানাপোড়েন বিষাদ, ক্লান্তি, ক্রোধ ইত্যাদিকে অগ্রাধিকার দিয়ে সমাজ পরিবর্তরে অঙ্গীকার ও দৃঢ় আশাবাদী সমৃদ্ধ ছিল আধুনিকতাবাদীদের উপজীব্যকাব্য। পাশাপাশি দূর্বোধ্যতা, জটিল চিন্তাভাবনা, উপমা ও চিত্রকল্পের বহুভাঙ্গনকে গুরুত্ব দেয়া হয়। দ্বৈততা, ও অনির্দিষ্টতাকে বৈশিষ্ট্য করা হল। বৈপরীত্য বা পরস্পর বিরোধী মনোভাবকে মেধাও মননের পরিচয় হিসাবে অগ্রগন্য করা হল। ফলে আধুনিক কবিতা উদ্দেশ্যহীনও দূর্বোধ্য হয়ে পড়লো। তবে স্বাধীনতার অপার মনোভাব সকলের কাছে তত্ত্ব হিসাবে আধুনিকতাবাদকে জনপ্রিয় করে তুললো। কবিতায় টিএস ইলিয়েট, এলিয়েটস, ফ্রস্ট, ওয়াসেল স্টিভেনস, অডেন, রবার্ট গ্রেভস, ডিলান টমাস, টেড হিউজ, সিলভিয়া প্লাঠ প্রমূখ বেশ জনপ্রিয় হলেন। বোদলেয়ারত ছিলেনই। এ ধারাকে বাংলা কাব্যে নিয়ে এলেন বুদ্ধদেব, জীবনানন্দ দাস, অমীয় চক্রবর্তী, সুধীন দত্ত ও বিষ্ণুদে। আধুনিক কবিতার অনেক নেগেটিভ ধারাকে চ্যালেজ্ঞ করে বিজ্ঞান কবিতাকে পজিটিভ করে উপস্থাপন করা হয়েছে। তার পূর্বে পোস্ট মডার্নিজম এসেছে। তার ব্যর্থতাও লক্ষ্য করা গেছে। মডার্নিজমের কুফল হিসাবে কবিতার জনপ্রিয়তা হ্রাস পায়। পাশাপাশি পোস্ট মডার্নিজম গ্রহনযোগ্যতা পায়নি। তাই আশির দশকে হাসনাইন সাজ্জাদীর হাতে বিজ্ঞান কবিতার চর্চা শুরু হয়।
ঝ. পোস্ট মডার্নিজম বা উত্তরাধুনিকতাবাদ প্রথম ব্যবহার হয় ল্যাটিন আমেরিকান কবি ফেদিরিকা দ্যা ওনিস এর দ্বারা তরুণ কবিদের নিয়ে স্প্যানিস ভাষার একটি কাব্য সংকলনের পোস্ট মডার্নিসমো নামকরণে। তবে এর তাত্ত্বিক হিসাবে জাঁ ফ্রাঁসোয়া লিওতোর, জ্যাক দেরিদা, মিশেল ফুকো, রিচার্ড ররোটি, জাঁ বোদ্রিয়ার প্রমূখকে। শুরুতেই এর নামকরন ও উৎস নিয়ে বিতর্ক ও হতাশা পরিলক্ষিত হয়। আধুনিকতাবাদের বিরোধীতায় মানুষের অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগিয়ে নতুন সাংস্কৃতিক আন্দোলন হিসাবে “পোস্ট মডার্নিজম ” কেচিহ্নিত করা হয়। পূর্ববর্তী দার্শনিক ভাবনাও সকল নির্মান কে ভেঙ্গে পূনঃ নির্মান ছিল উত্তর আধুনিকতার মূলে। তাই আধুনিকতার সম্প্রসারিত রূপ হিসাবে উত্তরাধুনিকতাকে তাই সহজেই চিহ্নিত করে ফেলা যায়। যারা মডার্নিজমকে একটি চলমান পদ্ধতি ভেবে থাকেন তারা বলেন, মডার্নিজমের ভেতর থেকেই কেলাসিত হয়ে আসছে পোস্টমডার্নিজম। ফলে ইউরোপের শিল্প বিপ্লব, ফরাসি বিপ্লব, চিনের সাংস্কৃতিক বিপ্লব, বা রাশিয়ার সমাজতান্ত্রীক বিপ্লবের পরও এবং তথ্যপ্রযুক্তির হাত ধরে বিশ্ব নতুন নতুন বাক নিলেও কবিতার বাক বদলে পোস্ট মডার্নিজম তেমন কোন ভূমিকা রাখতে পারেনি। তাই এখানে বিজ্ঞানবাদ বা বিজ্ঞানকাব্যতত্ত্ব জন্ম নেয়। কারণ পোস্টমডার্নিজমকে অস্তিত্বহীন ভাবা হয় মডার্নিজম ছাড়া। মডার্নিজমের ওপর ভিত্তি করে যেখানে পোস্টমডার্নিজম চলছে সেখানে ডিজিটাল বিপ্লবে বা চেতনায় যে চলমান বহুমাত্রিক বিপ্লব তা পোস্টমডার্নিজম গ্রহন করতে পারেনি। তাই ডিজিটাল বিপ্লবকে অবলম্বন করে, জৈবপ্রযুক্তির সাহায্যে চেতনার বৈপ্লবিক বহুমাত্রিকতায় বিজ্ঞানকাব্যতত্ত্ব পোস্টমডার্নিজমের গন্তব্যহীন বিদ্রোহীর চরিত্রকে অধিগ্রহন করে বিজ্ঞানবাদের উপস্থাপিত হল।
এখানে লক্ষনীয় যে, ক. পোস্টমডার্নিজম কেন্দ্র থেকে মুক্ত হয়ে ছোট ছোট সংগ্রামকে উৎসাহিত করে। কিন্তু এ দ্রোহকে একত্রিত হতে দেয়না। ফলে মানুষের বৃহত্তর ঐক্য গড়তে পারেনা পোস্টমডার্নিজম। এখানে বিজ্ঞানবাদ গোটা বিশ্বকে একই আদর্শে একই সংগ্রামে কেন্দ্রীভূত করতে চায়। তাই বিজ্ঞানবাদ তার ঠিক উল্টো।
খ. বিজ্ঞানবাদ একটি পরিপূর্ণ দর্শন। ৬ দফার আলোকে ও ১৮ কর্ম পদ্ধতিতে বিজ্ঞান কাব্যতত্ত্ব উপস্থাপিত হয়েছে। পোস্টমডার্নিজমে কোন যুক্তি মানা হয় না। কোন আদর্শ তাদের নেই। কিন্তু বিজ্ঞানবাদ ও বিজ্ঞানকাব্যতত্ত্ব তা নয়। বিজ্ঞানকাব্যতত্ত্ব কেবলমাত্র আদশিক এবং তা বিবর্তনবাদের আলোকে মানবমুক্তির লক্ষে সমিতিভিত্তিক অর্থব্যবস্থায় নতুন দর্শন।
গ. উত্তরাধুনিকতা পুঁজিবাদের বিশ্বায়ন। তারা তত্ত্বও দেয়না, সত্য ও দেয়না। বিজ্ঞানবাদ পুঁজিবাদ বিরোধী। ধনী-গরীবের ব্যবধান কমিয়ে আনতে চায় বিজ্ঞানবাদ তত্ত্ব এবং নিজস্ব একটি সত্য আছে বিজ্ঞানবাদের।
ঘ. অতীতের সকল কিছুই মন্দভাবে উত্তরাধুনিকতাবাদ। সকল কিছুতেই উত্তরাধুনিকতাবাদের প্রশ্ন ও সন্দেহ। বিজ্ঞানবাদে ঠিক তার উল্টো। অতীতকে রিফর্ম করতে চায় বিজ্ঞানবাদ। একেবারে বাদ দেয়া নয়।
ঙ. বিশ্বায়নবাদের বাস্তবায়নে দালালী করছে উত্তরাধুনিকতাবাদ। অধ্যাপক আবুল কাসেম ফজলুল হকের মতে ‘এর পেছনে কলকাটি নাড়ছে আমেরিকা।’ বিজ্ঞানবাদ পুরো বিশ্বকে- পুঁজিবাদ ও মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের নাগপাশ থেকে মুক্তি দিতে চায়।
চ. উত্তরাধুনিকতাবাদ জাতি, রাষ্ট্র, জাতীয়তাবাদ, জাতীয়তাবোধ ও রাষ্ট্রের সীমানা মানেনা। বিজ্ঞানবাদ নতুন দর্শনের আলোকে নতুন জাতি রিফর্ম করবে, নতুন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা দেবে।
ছ. উত্তরাধুনিকতাবাদীগন লোকসংগীতকে প্রাধান্য দেয়। উচ্চাঙ্গসংগীতকে তারা মানেনা। বিজ্ঞানবাদ শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের বিবোধী নয়। লোকসংগীতের ও তারা বিরোধীতা করে না। তবে বিজ্ঞানসংগীত তারা জন্ম দিতে চায় নতুন সংগীত হিসাবে। যেখানে বিজ্ঞানের উপমা, উৎপ্রেক্ষাও চিত্রকল্প থাকবে। গ্রহ-নক্ষত্রে বসবাসকে উৎসাহিত করবে যে সংগীত।মানুষের অধিকারকে বড়করে বিজ্ঞানসঙ্গীত রচিত হবে।
৩.বিজ্ঞানবাদ ও বিজ্ঞানকাব্যতত্ত্ব; বিজ্ঞানে সকল মানুষ সমান। সকলের অধিকার সমান। চলমান সম্পদকে তাই তিনভাগ করে বিজ্ঞানবাদ সমিতিভিত্তিক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করতে চায়। এটাকে বিজ্ঞানবাদ কল্যান রাষ্ট্র বলে থাকে। বিজ্ঞানবাদ প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে বিজ্ঞান মনস্ক একদল কবি তৈরি করতে চায় বিজ্ঞানবাদ। সে লক্ষ্য থেকেই বিজ্ঞান কাব্যতত্ত্বও সাবলীল ছন্দ’র আবিষ্কার। অতীতের সকল আন্দোলনের বিজ্ঞানমনস্কতা এবং ডিজিটাল বিপ্লবের সুবিধার স্বীকৃতিসহ জাতিকে বিজ্ঞানমনস্ক করার জন্য বিজ্ঞান কাব্য চিন্তার বিকাশ ঘটাতে চায় বিজ্ঞানবাদ।
বিজ্ঞানকাব্যতত্ত্বের ৬দফা হচ্ছে-১. কবিতার উপমা, উৎপ্রেক্ষাও চিত্রকল্পে বিজ্ঞানের আবিষ্কার ও অনাবিষ্কারের প্রয়োগ, ২. ছোট ক্যানভাসে বড় উপমা,৩. রিপোটিং স্টাইলে সাবলীল ছন্দে দাড়ি, কমার কবিতা, ৪. নারী পুরুষ লিঙ্গ বৈষম্য বিরোধী কবিতা যা মানুষের হাতে লেখা ও মানুষের জন্য লেখা, নারী-পুরুষ, সাদা-কালো, ধনী-গরীবের ভেদাভেদ কমিয়ে আনতে চায় বিজ্ঞান কবিতা,৫. বিজ্ঞান সময়কে ধরে রেখে কাব্যচর্চা। সময় ও ডিজিটাল বিপ্লবকে কবিতায় চিত্রায়িত করতে হবে। আধুনিকতাকাল আমাদেরকে দিয়েছে ইলেকট্রিসিটি আর বিজ্ঞান যুগে আমরা পেয়েছি ইলেকট্রনিক্স। যার মাধ্যমে আমরা পিসিতে প্রবেশ করেছি। এখন পার্সোনাল কম্পিউটার ও এনড্রয়েডে আমরা পাচ্ছি ইন্টারনেট। ঘরে বসে সবই করছি নেটের মাধ্যমে। এটাই বিজ্ঞান যুগ, এবং ৬. ধর্ম নিরপেক্ষ কবিতা। আগের সকল ধারাতেই ধর্মকে অস্বীকার করা হয়েছে। বিজ্ঞানবাদে ধর্ম নিরপেক্ষতাকে অবলম্বন করা হয়েছে। ধর্মকে নয়।
আর ১৮ দফা কর্মপদ্ধতির প্রয়োগে রয়েছে ১.বৈশ্বিক উষ্ণতা, বরফগলা, গ্রিনহাউজ এ্যাফেক্ট, কার্বন ডাই-অক্সাইড ও বাতাসে সিসার পরিমান কমানো, ২.ভূমির ক্ষয়রোধ নিঃসরন এবং জলভাগ বৃদ্ধিরোধ, ৩.জনসংখ্যার বিস্ফোরন রোধ ৪ ভৌতিক বিশ্বাস পরিহার, ৫.ধর্মে ধর্মে হানাহানি বন্ধ ৬. ধর্মীয় সম্প্রীতির কবিতা, ৭.ধনীগরীবের ব্যবধান কমিয়ে আনা, ৮. নারী-পুরুষ বৈষম্য রোধ করা, ৯. নারীও শিশুর প্রতি সহিংসতা বন্ধ, ১০.উপমা উৎপ্রেক্ষাও চিত্রকল্পে প্রকৃতির পরিবর্তে যথাসম্ভব বিজ্ঞানের প্রয়োগ, ১১. ধর্মনিরপেক্ষ কবিতা, ১২. যৌন স্বাধীনতাকে উৎসাহিত করা ১৩.বিবর্তনবাদের চর্চাকে উৎসাহিত করা, ১৪.গ্রহ-নক্ষত্রে বসবাসকে জনপ্রিয় করা, ১৫.পরমাণুর যথেচ্ছ ব্যবহার রোধ, ১৬. রাসানিকের ব্যবহার রোধ, ১৭. দেশে দেশে স্বাধীনতা সংগ্রামীদের সমর্থন এবং ১৮. বিজ্ঞানবাদের আলোকে সারা বিশ্বে কল্যাণ রাষ্ট্রপ্রতিষ্ঠার আন্দোলন জোরদার করে কাব্যচর্চা করা।
উপরোক্ত ৬দফা ও ১৮ কর্মপদ্ধতির বিশ্লেষণে প্রতীয়মান হয় যে, বিজ্ঞানবাদ দর্শন এবং বিজ্ঞান কাব্যতত্ত্বের উপস্থাপন ও সাবলীল ছন্দের জন্ম বিজ্ঞান যুগ বিজ্ঞান কবিতার জন্যেই উপযোগী। যা মডার্নিজমও পোস্ট মডার্নিজমের অসারতা প্রমাণ করে একটি সাংস্কৃতিক বিপ্লবের ক্ষেত্র প্রস্তুতের কাব্য আন্দোলন। যার নাম হাসনাইন সাজ্জাদীর বিজ্ঞান কবিতা আন্দোলন। বিজ্ঞান কবিতা সে আন্দোলনেরই ফসল। নতুন ধারার কাব্য নির্মানও নতুন সমাজ প্রতিষ্ঠায় বিজ্ঞানবাদ একটি কল্যাণকর দর্শন। বিজ্ঞানকাব্যতত্ত্ব আগামী দিনের সাহিত্যতত্ত্ব। যা নিয়ে আজকেই আলোচনা করা আবশ্যক।
admin@masudbdtech.blogspot.com
No comments