ইসলামের দৃষ্টিতে সেলফি আসক্তি
বর্তমানে একটি শিশু জন্মের পর থেকেই কোনো না কোনো
প্রযুক্তির মধ্য দিয়ে বড় হচ্ছে। প্রযুক্তির সহজতর মাধ্যম হচ্ছে মুঠোফোন। বিশ্বের
বেশির ভাগ মানুষ মুঠোফোনের মাধ্যমে ইন্টারনেটভিত্তিক সোশ্যাল মিডিয়ার সঙ্গে
সম্পৃক্ত। প্রযুক্তি মানুষের উপকার যেমন করে, তেমনি ক্ষতিও করে।
প্রযুক্তির অতিরিক্ত ব্যবহার এবং এর অপব্যবহার আমাদের মানসিক রোগী বানিয়ে দিচ্ছে।
মোবাইলের সঙ্গে যে দিন থেকে ক্যামেরা যুক্ত হয়েছে, সে দিন থেকেই এর
নেতিবাচক দিকের দ্বার উন্মোচিত হয়েছে। শুরু হয়েছে প্রয়োজনে-অপ্রয়োজনে ছবি
তোলা। মুঠোফোনের নেতিবাচক ব্যবহারের যে দিকটি মানুষের, বিশেষ
করে তরুণ প্রজন্মের খুবই ক্ষতি করছে তা হলো 'সেলফি'।
সেলফি কী? নিজের
প্রতিকৃতির ইংরেজিই সেলফি। একটি ছবি (আলোকচিত্র), যা নিজেরই তোলা
নিজের প্রতিকৃতি, সাধারণত স্মার্টফোন বা ওয়েব ক্যামেরায় ধারণ করা
এবং তা কোনো সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে আপলোড (তুলে) দেওয়া। বর্তমানে কে কত
ইউনিকভাবে সেলফি তুলে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে পোস্ট করতে পারে, তা
নিয়ে চলছে প্রতিযোগিতা। সেলফি না তুললে কি আর ভদ্র হওয়া যায়? তাই
তো 'ভদ্রলোকেরা' গায়ের গেঞ্জি খুলে
মশারিতে ঢুকতে যাবেন, এমন সময়ও তুলছেন 'সেলফি'।
হজ করতে গিয়েও কাবাঘরের সামনে ছবি তুলছেন 'সেলফি'।
তা আপলোডও করছেন অকপটে। গাড়ির স্টিয়ারিংয়ে বসে সেলফি তুলতে গিয়ে সড়ক
দুর্ঘটনার শিকার হয়েছেন অনেকে। সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের সানডিয়াগো শহরের ডট
ফ্যাসলারের সাপের সঙ্গে সেলফি তোলার খবরটিতে তোলপাড় সৃষ্টি হয়। সেলফি তুলতে
গিয়ে সাপের কামড়ে হাসপাতালে বিল গুনেছেন এক লাখ ৫৩ হাজার ১৬১ ডলার (এক কোটি ১৭
লাখ টাকা প্রায়)। (দৈনিক কালের কণ্ঠ : ২৭-০৭-২০১৫) গবেষকরা বলছেন, এই
সেলফি-প্রবণতা ভয়ংকর ও বিপজ্জনক হতে পারে। মানসিক স্বাস্থ্যকে ঝুঁকির মুখে ফেলে
দিতে পারে। ইন্টারন্যাশনাল বিজনেস টাইমসের এক খবরে এ তথ্য জানানো হয়েছে। আমেরিকান
সাইকিয়াট্রিক অ্যাসোসিয়েশন (এপিএ) মানসিক ব্যাধির সঙ্গে সেলফি তোলার সম্পর্কটি
নিশ্চিত করেছে। (দৈনিক প্রথম আলো : ০৩-০৪-২০১৪)। এই মানসিক সমস্যাটির নাম
সেলফিটিস। মনোবিজ্ঞানীরা বলছেন, যারা খুব বেশি সেলফি তোলে তারা সামাজিক
ব্যবস্থায় ব্যক্তিত্বহীনতার পরিচয় দেয়। সেলফি আক্রান্তদের বেশির ভাগই কর্মজীবনে
ও ব্যক্তিজীবনে ব্যর্থতার পরিচয় দেয় এবং সাধারণদের চেয়ে তাদের কনফিডেন্ট লেভেলও
কম থাকে। তারা হতাশা ও মেন্টাল ডিপ্রেশনে আক্রান্ত। যাদের খুব বেশি সেলফি তুলতে
ইচ্ছা হয়, তাদের চিকিৎসার প্রয়োজন। (আলোকিত বাংলাদেশ : ০৮-০৪-২০১৫)
উন্মাদনা কোন
জায়গায় পৌঁছলে সাপের সঙ্গে সেলফি তুলতে পারে তা সহজেই অনুমেয়। যে কাজটি মানুষের
মানসিক ভারসাম্যকে কমিয়ে দেয়, ইসলামের মতো কল্যাণধর্মী জীবনবিধান কি এর পক্ষে
থাকতে পারে? চাকরি কিংবা ব্যবসার জন্য কি সেলফির কোনো
প্রয়োজন হয়? সেলফি মানেই তো অপ্রয়োজনে ছবি তোলা। ইসলামে তা
হারাম। তবে বিশেষ প্রয়োজনে ছবি তোলা বৈধ। কিছুদিন আগে দারুল উলুম দেওবন্দের প্রধান
আল্লামা মুফতি আবুল কাসেম নোমানী তাঁর ফতোয়ায় উল্লেখ করেন, পরিচয়পত্র
ও পাসপোর্ট তৈরির মতো একান্ত প্রয়োজন ছাড়া ইসলামে ছবি তোলা হারাম। (ইত্তেফাক :
১২-০৯-২০১৩) কোরআন, হাদিস, ইজমা ও কিয়াসের
ভিত্তিতে পৃথিবীর সব ইমাম ও ফিকহ বিশেষজ্ঞ ও সমকালীন মুফতিদের অভিমত হলো, অতি
প্রয়োজন ছাড়া ছবি তোলা, আঁকা এবং তা প্রকাশ করা জায়েজ নয়। (ফিকহি
মাকালাত; তকি উসমানী : ৪/১২৩)
রাসুলুল্লাহ
(সা.)-এর বাণীতে তো আরো কঠোর হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করা হয়েছে। হজরত রাসুলুল্লাহ
(সা.) বলেন, 'হাশরের দিন সর্বাধিক আজাবে আক্রান্ত হবে তারাই, যারা
কোনো প্রাণীর ছবি তোলে অথবা আঁকে।' (বুখারি : ৫/২২২২)
ইসলামে অপ্রয়োজনে
ছবি তোলা হারাম। এমন তো নয় যে ছবি না তুললে আমার অনেক ক্ষতি হয়ে যাবে! তবু
মুসলমানদের সেলফিকাণ্ড থেমে নেই। ছবি বা সেলফি অপ্রয়োজনে যেকোনো জায়গায় তোলা
অন্যায়, তা যদি আবার পবিত্র কাবার আঙিনায় হয়? শিষ্টাচারবহির্ভূত
নয় কি? অনেকে তো নিজেরা সেলফি না তুললেও অন্যের সেলফিতে
লাইক দিতে ভুল করছেন না। কারো সেলফিতে লাইক দেওয়া মানেই তাকে সমর্থন করা। উৎসাহ দেওয়া। আর গুনাহর কাজে কাউকে সমর্থন কিংবা উৎসাহ দেওয়াও মারাত্মক অন্যায়। পবিত্র কোরআনুল কারিমের
ইরশাদ হয়েছে, 'তোমরা তাকওয়ার কাজে একে অন্যকে সাহায্য করো। তবে
গুনাহ ও শত্রুতার কাজে কেউ কাউকে সাহায্য কোরো না।' (সুরা মায়িদা : ২)
No comments