কোটা আন্দোলনের নূর ডাকসুর ভিপি
অনিয়মের নানা অভিযোগ এবং অধিকাংশ প্যানেলের প্রার্থীদের বর্জনের মধ্যে ২৯ বছর পর অনুষ্ঠিত ডাকসু নির্বাচনে ক্ষমতাসীন দল সমর্থিত ছাত্রলীগ অন্য প্রায় সব পদে জয়ী হলেও ভিপি পদটি জিতে নিয়েছেন কোটা সংস্কার আন্দোলনকারীদের নেতা নূরুল হক নূর।
সোমবার অনুষ্ঠিত এই নির্বাচনে ছাত্র হল সংসদগুলোতেও ছাত্রলীগ একচেটিয়া জয় পেলেও ছাত্রী হলগুলোকে জয়ী হয়েছে কোটা সংস্কারের আন্দোলনকারী স্বতন্ত্র প্রার্থীরা।
এবারই প্রথম সরকারি দল সমর্থিত ছাত্র সংগঠনকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদে (ডাকসু) অধিকাংশ আসনে বিজয়ী হতে দেখা গেলেও ভিপি পদের ক্ষেত্রে আগের ধারাবাহিকতাই থাকল।
তবে স্বাধীনতার পর এবারই প্রথম ছাত্র সংগঠনগুলোর প্যানেলের বাইরে থেকে কাউকে ডাকসুর ভিপি পদে দেখার সুযোগ ঘটছে।
সরকারি চাকরিতে কোটা সংস্কারের দাবিতে গত বছর বাংলাদেশ সাধারণ ছাত্র অধিকার সংরক্ষণ পরিষদ ব্যানারে জোরাল আন্দোলনের নেতৃত্ব দিয়ে পরিচিত পান এই ফোরামের যুগ্ম আহ্বায়ক নূর।
তারপর হামলা, মামলা, নির্যাতনের সয়ে ইংরেজি বিভাগের এই ছাত্র এবার শিক্ষার্থীদের প্রতিনিধি হয়ে যাচ্ছেন ডাকসুতে।
ভিপি পদে নূর পেয়েছেন ১১ হাজার ৬২ ভোট। তার নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী ছাত্রলীগের সভাপতি রেজওয়ানুল হক চৌধুরী শোভন পেয়েছেন ৯ হাজার ১২৯ ভোট।
সোমবার ভোটগ্রহণের সময় রোকেয়া হলে নূরের উপর ছাত্রলীগ হামলা চালায় বলে অভিযোগ উঠেছে। দুপুরের ওই ঘটনায় আহত হন এই ভিপি প্রার্থী; যদিও একে ‘নাটক’ বলেছেন ছাত্রলীগ সাধারণ সম্পাদক গোলাম রাব্বানী।
রোকেয়া হল থেকে সহকর্মীরা বের করে আনছে নূরুল হক নূরকে; তিনি ছাত্রলীগের হামলায় আহত হন বলে অভিযোগ।
জিএস পদে ছাত্রলীগের রাব্বানীই ১০ হাজার ৪৮৪ ভোট হয়ে বিজয়ী হয়েছেন। তার নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী সাধারণ ছাত্র অধিকার সংরক্ষণ পরিষদের রাশেদ খান পেয়েছেন ৬ হাজার ৬৩ ভোট।
এজিএস পদে জয়ী হয়েছেন ছাত্রলীগের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সাধারণ সম্পাদক সাদ্দাম হোসেন ১৫ হাজার ৩০১ ভোট। তার নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী সাধারণ ছাত্র অধিকার সংরক্ষণ পরিষদের ফারুক হোসেন পেয়েছেন ৫ হাজার ৮৯৬ ভোট।
রাত সাড়ে ৩টার পর সিনেট ভবনে উপাচার্য ও ডাকসুর সভাপতি অধ্যাপক আখতারুজ্জামান যখন বিজয়ীদের নাম ঘোষণা করছিলেন, তখন সেখানে ছাত্রলীগের ভিপিপ্রার্থী শোভনসহ অন্যরা উপস্থিত ছিলেন।
ভিপি পদে নূরের নাম বিজয়ী হিসেবে ঘোষণার সঙ্গে সঙ্গে হৈ চৈ শুরু করেন, তারা ভিপি পদের ফল না মানার ঘোষণা দিয়ে শিক্ষক লাঞ্ছনা ও ব্যালট ছিনতাইকারীয়ের জন্য নূরকে দায়ী করে তাকে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বহিষ্কারের দাবি জানান।
রাব্বানী বলেন, “সাধারণ শিক্ষার্থীদের ইমোশনকে ব্যবহার করে রোকেয়া হলের প্রভোস্টের উপর হামলা চালিয়েছে। সাধারণ শিক্ষার্থীরা মামলা করেছে। আমরা ব্যবস্থা নেওয়ার দাবি জানাই।”
নূরকে ইসলামী ছাত্রশিবির সংশ্লিষ্ট দাবি করেও স্লোগান তোলেন ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীরা।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদের (ডাকসু) ২৫টি পদের ২৩টিতে ছাত্রলীগের প্যানেলের (সম্মিলিত শিক্ষার্থী পরিষদ) প্রার্থীরাই জয়ী হয়েছেন।
ভিপির পাশাপাশি সমাজসেবা সম্পাদক পদে সাধারণ ছাত্র অধিকার সংরক্ষণ পরিষদের আখতার হোসেন জয়ী হয়েছেন।
ছাত্রলীগের প্যানেল থেকে বিজয়ী অন্যরা
মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক সম্পাদক- সাদ বিন কাদের
বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি সম্পাদক- আরিফ ইবনে আলী
কমনরুম ও ক্যাফেটেরিয়া সম্পাদক- বিএম লিপি আক্তার
আন্তর্জাতিক সম্পাদক- শাহরিমা তানজিনা অর্নি
সাহিত্য সম্পাদক- মাজহারুল কবির শয়ন
সাংস্কৃতিক সম্পাদক- শামস ই নোমান
ক্রীড়া সম্পাদক- শাকিল আহমেদ তানভীর
ছাত্র পরিবহন সম্পাদক- রাকিব হাওলাদার
সদস্য
চিবল সাংমা, নজরুল ইসলাম, রাকিবুল হাসান, রাকিবুল ইসলাম ঐতিহ্য, তানভীর হাসান সৈকত, রাইসা নাসের, সাবরিনা ইতি, ইশাত কাশফিয়া ইরা, নিপু ইসলাম তন্বী, হাইদার মোহাম্মদ জিতু, তিলোত্তমা শিকদার, জুলফিকার আলম রাসেল ও মাহমুদুল হাসান
|
এই নির্বাচনে ভোটগ্রহণ শেষ হওয়ার আগে অধিকাংশ প্রার্থীর সঙ্গে নূরুল হক নূরের প্যানেলও নির্বাচন বর্জনের ঘোষণা দিয়েছিল।
ছাত্রদল, বাম জোট ও স্বতন্ত্র প্যানেলের প্রার্থীরা ব্যাপক কারচুপির অভিযোগ তোলেন। আগে থেকে ব্যালট বাক্স ভর্তি করা হয়েছিল বলে তাদের অভিযোগ, ছাত্রলীগের বিরুদ্ধে ভোটারদের বাধা দেওয়া অভিযোগও তুলেছেন।
এই নির্বাচন বাতিলের দাবিতে উপাচার্য ভবন ও কার্যালয়ের সামনে বিক্ষোভের পর ভোট বর্জনকারীদের পক্ষে মঙ্গলবার বিক্ষোভের ডাক দিয়েছেন বাম জোটের ভিপি প্রার্থী ছাত্র ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক লিটন নন্দী।
বিভিন্ন অনিয়মের চিত্র তুল ধরে নতুন নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার আহ্বান জানিয়েছেন নিজস্ব উদ্যোগে নির্বাচন পর্যবেক্ষণকারী আটজন শিক্ষকও।
অন্যদিকে ছাত্রলীগ নেতারা দাবি করেছেন, নির্বাচনকে প্রশ্নবিদ্ধ করতে এবং তাদের ঠেকাতে ছাত্রদলসহ অন্য প্যানেলগুলো পরিকল্পিতভাবে ‘নাটক’ সাজিয়েছে।
বিচ্ছিন্ন দুই-একটি ঘটনা ছাড়া সুষ্ঠু ও উৎসবমুখর নির্বাচন হয়েছে বলে উপাচার্য অধ্যাপক আখতারুজ্জামান দাবি করলেও এই নির্বাচনের প্রধান রিটার্নিং কর্মকর্তা অধ্যাপক মাহফুজুর রহমান কুয়েত মৈত্রী হলের ঘটনায় ‘বিব্রত ও ভাষাহীন’ হওয়ার কথা বলেছেন।
৪৩ হাজার ভোটারের জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের ১৮টি হলে স্থাপিত কেন্দ্রে সকাল ৮টায় ভোটগ্রহণ শুরুর কথা থাকলেও কুয়েত মৈত্রী হলে ভোট দেওয়া বস্তাভরতি ব্যালট পেপার উদ্ধার হওয়ায় এবং রোকেয়া হলে ব্যালট বাক্স নিয়ে শিক্ষার্থীদের সন্দেহে ভোটগ্রহণ শুরু হয়নি নির্দিষ্ট সময়। পরে ওই দুই ছাত্রী হলে দেরিতে শুরু হয়ে ভোটগ্রহণ চলে সন্ধ্যা পর্যন্ত।
ডাকসুর ২৫টি পদের পাশাপাশি হল ছাত্র সংসদের ১৩টি পদে নিজেদের প্রতিনিধি নির্বাচনে ভোট দেন শিক্ষার্থীরা।
ভোটগ্রহণের পর গণনা শেষে হল সংসদগুলোর ফল হলেই ঘোষণা করেন রিটার্নিং কর্মকর্তারা।
সব হল থেকে ফলাফল পৌঁছনোর পর কেন্দ্রীয় সংসদ অর্থাৎ ডাকসুর ফল ঘোষণা করা হয় নওয়াব আলী চৌধুরী সিনেট ভবন থেকে। উপাচার্য বলেন, তিনি প্রধান রিটার্নিং কর্মকর্তার তৈরি করা ফলাফল উপস্থাপন করছেন।
এই নির্বাচনে বিভিন্ন রাজনৈতিক ছাত্র সংগঠনের প্যানেল থাকলেও ছাত্রলীগের সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতায় ছিল নির্দলীয় ছাত্রদের প্যানেলের প্রার্থীরা; যা আগে কখনও দেখা যায়নি।
স্বাধিকার স্বতন্ত্র পরিষদ, স্বতন্ত্র জোট নামে স্বতন্ত্র প্রার্থীরা দুটি জোট করে এবার নামে ভোটের লড়াইয়ে। কোটা সংস্কারের আন্দোলনকারী সাধারণ ছাত্র অধিকার সংরক্ষণ পরিষদও দেয় পূর্ণ প্যানেল।
সংগঠনগুলোর মধ্যে ছাত্রদল, বাম জোট, জাসদ ছাত্রলীগ, ছাত্রলীগ-বিসিএল, বাংলাদেশ ছাত্র মৈত্রী, ইশা ছাত্র আন্দোলন, সাংস্কৃতিক মুক্তিজোট ও ছাত্র সমাজের পূর্ণ প্যানেল ছিল।
মোট ১২টি প্যানেলের বাইরেও ভিপি পদে ৯ জন এবং জিএস পদে ২ জন স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়ে প্রতিদ্বন্দ্বিতায় ছিলেন। ভিপি পদে মোট প্রার্থী ছিলেন ২১ জন; জিএস পদে ১৪ জন এবং এজিএস পদে ১৩ জন প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন।
এক মিছিলে ভোট বর্জনকারীরা; তারা মঙ্গলবার বিক্ষোভের কর্মসূচি দিয়েছে
সব মিলিয়ে ডাকসুতে ২৫ পদের বিপরীতে প্রার্থী ছিলেন ২২৯ জন; ১৮টি হল সংসদে ১৩টি করে ২৩৪টি পদের বিপরীতে ৫০৯ জন নেমেছিলেন ভোটের লড়াইয়ে।
বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসের সবগুলো বাঁকে ছাত্র সমাজের অগ্রণী ভূমিকার কেন্দ্রে থাকা ডাকসুর সর্বশেষ নির্বাচন হয়েছিল ১৯৯০ সালে। এরশাদ সরকারের আমলে ওই নির্বাচনে ছাত্রদল জয়ী হয়েছিল; ভিপি হয়েছিলেন আমানউল্লাহ আমান, জিএস হয়েছিলেন খায়রুল কবির খোকন।
এরপর কয়েক দফায় নির্বাচনের উদ্যোগ নেওয়া হলেও তা আলোর মুখ দেখেনি।
এই নির্বাচন অনুষ্ঠানে আবেদন হলে গত বছর আদালতে এই মার্চের মধ্যে ভোট আয়োজনের সময় বেঁধে দেয়। এরপর নির্বাচনের উদ্যোগ নেয় বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন।
No comments