বিহঙ্গ দৃষ্টিতে প্রতীচ্য সাহিত্য-সমালোচনা তত্ত্ব
গ্রিক ভাষায় Theory শব্দের মূলে আছে পর্যবেক্ষণ, যা দেখা হয়েছে। বাস্তব জগৎকে আমরা দৃশ্যমান রূপে দেখি ও তা থেকে বাস্তবতা নিরূপণ করি। তেমনি সাহিত্যকর্মকে দেখাই সমালোচনার মূল লক্ষ্য একভাবে নয়, অনেকভাবে দেখা। দেখার কাজটি সম্পন্ন হয় মস্তিষ্কের ক্রিয়াশীলতায় এবং তা দৃষ্টিভঙ্গির জন্ম দেয়। সমালোচনাও মস্তিষ্কসঞ্জাত বৌদ্ধিক ক্রিয়া। বস্তুজগতকে রূপান্তর বা পুনর্নির্মানের বা সৃষ্টিক্ষমতা তা থেকেই উৎপন্ন হয় জ্ঞান-বিজ্ঞান-সাহিত্য। আমাদের জ্ঞানবিজ্ঞানের নিয়মনীতির সঙ্গে এই সৃষ্টিক্ষমতার বৌদ্ধিক ক্রিয়াটি সংশ্লিষ্ট; যেমন কবিতা জন্মের সঙ্গে-সঙ্গেই সমালোচনারও উদ্ভব ঘটেছিল বাল্মীকির মিথকথায়। ক্রৌঞ্চবধের বেদনাবহ ঘটনা দেখে বাল্মীকির মনে উপজাত লোকের উৎসারণ ঘটেছিল শ্লোক শব্দ রূপে, প্রথম বাক্যে ছন্দোবন্ধ ভাষায় প্রকাশ আর পরের বাক্যেই বিস্ময় ‘এ আমি কী বললাম।’ ‘কিমিদং ব্যহৃতং ময়া।’ বেদনার্ত বিস্ময় থেকেই জন্ম নিয়েছে কবিতার নিশ্লেষণ, যেমন করে বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের সৃষ্টিরহস্য ও সৌন্দর্যের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে বিমুগ্ধ ঋষিরা তৈরি করেছিলেন শ্লোক-পূরাণ-গল্প-গাথা। এগুলো মানুষের দেখাকে নিয়ে যায় ব্যাখ্যায়নের সংবদ্ধ পদ্ধতি গড়ে তোলার দিকে; তার জ্ঞানসত্তার ক্রিয়াশীলতার মধ্যে দেখাটি জারিত হয়। এ সূত্রেই সমালোচক নৃতত্ত্ববিদ, নরথ্রপ ফ্রাই বলেন, সাহিত্য অধ্যয়ন করে সাহিত্য সৃষ্টি করা যায় না। সাহিত্য সম্পর্কিত জ্ঞানও অর্জন করা যায় না।
কেবল সাহিত্যতত্ত্ব ও সমালোচনা-বিজ্ঞানের মাধ্যমেই আমরা সাহিত্যজ্ঞান পেতে পারি, সাহিত্যগুণকে বুঝতে পারি (Anatomy of Criticism, 1957)। সকল দেশেই বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে সাহিত্য পড়ানো হয় সাহিত্য সম্পর্কিত সমালোচনা তত্ত্বের সূত্র দিয়ে। আমরা সমালোচনাতত্ত্বকে ‘বিজ্ঞান’ বলছি সচেতনভাবেই, কারণ প্রাকৃতিক বিজ্ঞানের তত্ত্ব ব্যবহার করে প্রযুক্তি তৈরি হয়, আর সে প্রযুক্তি সমাজের উৎপাদন-ব্যবস্থায় পুরানোকে বদলে দিয়ে নতুন সম্পর্ক গড়ে তোলে এবং এই গোটা প্রক্রিয়াটির ধারায় সম্পৃক্ত হয়ে পড়ে সাহিত্যতত্ত্ব, সমালোচনা-পদ্ধতি। ফলে সাহিত্য সমালোচনার ক্ষেত্রে অবধারিতভাবেই প্রাকৃতিক বিজ্ঞানের অনুরূপ একটি তাত্ত্বিক ভিত্তি গড়ে তুলতে হয় যা দিয়ে সাহিত্যকর্মকে বর্ণনা করা যায়, সে বর্ণনা দিয়ে নতুন-নতুন রীতি-পদ্ধতি গড়া যায়, এই নতুন রীতি দিয়ে আবার পুরানো কাঠামোকে ভেঙে আরো নতুনতর সৃষ্টিকর্মে যাওয়া যায়। কাজেই বিজ্ঞানের মতোই সাহিত্য-সমালোচনা-তত্ত্ব এক অবিরাম সৃষ্টিমুখর ক্রিয়মানতা প্রাচীনকাল থেকে বর্তমান সময় পর্যন্ত এর বিস্তার ও পথযাত্রা বিপুল ও ক্রমশ মহাপথের অভিমুখী। বিজ্ঞানের পদ্ধতি যেমন নানা তত্ত্বের পরীক্ষা-প্রমাণের মধ্য দিয়ে এগিয়ে যায়, থিয়োরির বদল ঘটায়, নতুন থিয়োরি আবিষ্কার করে, সমালোচনা-তত্ত্বও বিভিন্ন পদ্ধতি নিয়ে নিরীক্ষা করে, পর্যবেক্ষণের ক্ষেত্র পরিবর্তন করে। কারণ বিশুদ্ধ সাহিত্যিক প্রতিক্রিয়া বা পাঠ বলে কিউ নেই, সকল প্রতিক্রিয়াই গভীরভাবে সম্পৃক্ত থাকে আমরা কোন সময়ে ও কী ধরণের সামাজিক ঐতিহাসিক ব্যক্তিমানুষ তার সাথে। কারণ স্থানÑকাল নির্ভর সাহিত্যরচনার দীর্ঘ ইতিহাসের দিকে তাকালে দেখা যাবে যে, কীভাবে তা ধর্ম-দর্শন-বিজ্ঞান-রাজনীতি-অর্থনীতি-মনস্তত্ত্ব-প্রকৃতি সর্বোপরি ভাষাস্তর ইত্যাদি জ্ঞানকা- দ্বারা বিনির্মিত, বিবর্তিত এবং বিচিত্র।
তবে সাহিত্য ওইসব জ্ঞানকাঠামো থেকে স্বরূপত পৃথক, এর কাঠামোতে আছে মানবিকতার কেন্দ্রীয় অংশ-যার অভিধা নান্দনিকতা, মানুষ মাত্রে সৃষ্টিক্ষম প্রজ্ঞার অধিকারী। এই মৌল কাঠামোকে ছন্দে-ধ্বনিতে চিত্রে রূপান্তরিত করার বিচিত্র শক্তিশালী ক্ষমতার চর্চা করে। আর প্রতিটি সাহিত্যকর্ম সর্বদাই এমন এক কার্যকর রচনা যা মানুষকে তার অভ্যাসগত কোড ও প্রত্যাশার সংঘর্ষে একটি নতুন সমালোচনামূলক চেতনায় নিয়ে যায়, তাকে একইসঙ্গে করে তোলে সমালোচক, আবিস্কারক কতকটা কতকটা বিজ্ঞানীর মতোই। সমালোচনার মাহাত্ম্যই হল ‘আমাদের গভীরতর আত্মসচেতনতায়’ নিয়ে যাওয়া এবং আমাদের অস্তিত্বের আরো সমালোচনামূলক দর্শনে উপনীত হতে অনুঘটকের কাজ করা। সাহিত্য ও সমালোচনাতত্ব নির্মাণের ক্ষেত্রে তাই সক্রিয় থাকেন। একদিকে স্বয়ং শিল্পী সাহিত্যিকরা, অন্যদিকে নন্দনতাত্ত্বিক সমাজবিদ-দার্শনিক এমনকি বিজ্ঞানীরাও, কোনো কোনো ক্ষেত্রে রাজনৈতিক বিপ্লবী নেতা ও ধর্মবেত্তারাও। ফলে বিপুলকায় এই তত্ত্বক্ষেত্র জটিল, পরস্পরিত আবার বৈপরীত্যময়ও প্রাচ্যে পাশ্চাত্যে সর্বত্র এর বিকাশ ও বিবর্তন বহুত্ববাদিতায় বিমণ্ডিত।
এক
আমরা প্রাচীন গ্রিক সাহিত্যে প্রথম সমালোচনার উপাদান পাই নাট্যকার অ্যারিস্টোফেনিসের (খৃ পূ ২৫৭-১৮০) ফ্রগস নামের কমোডিতে।
আমরা প্রাচীন গ্রিক সাহিত্যে প্রথম সমালোচনার উপাদান পাই নাট্যকার অ্যারিস্টোফেনিসের (খৃ পূ ২৫৭-১৮০) ফ্রগস নামের কমোডিতে।
ধ্রুপদী সাহিত্য-সমালোচনাতত্ত্বের চার পুরুষই গ্রিসের প্লেটো, আরিস্টটল হোরেস, লঙ্গিনুস। তৎকালে জ্ঞানশাখাগুলি বিশেষায়িত ছিল না বলে এঁরা কেউ কেউ দার্শনিক, রাষ্ট্রবিজ্ঞানী ,প্রকৃতি বিজ্ঞানী, চিকিৎসাবিদও ছিলেন, আর ছিলেন গ্রিক সমাজ ও রাষ্ট্রবাদের পরিম-লে বিকশিত ও তার ভাবাদর্শ দ্বারা বিন্যস্ত। লক্ষ্যযোগ্য যে সমাজ শ্রেণি ও রাষ্ট্রকাঠামোর স্থিরাদর্শের প্রতি আনুগত্য রক্ষা ও বিরোধিতা নস্যাতের প্রয়োজনীয়তা, এক কথায় রাষ্ট্রের কাঠামো অক্ষুন্ন ও শক্ত করার লক্ষ্যে বিশেষ করে প্লেটো তাঁর ভাববাদী দর্শনের প্রতিষ্ঠা দেন যা দুই আড়াই হাজার বছর ধরে মানবচিন্তাকে, তার সাহিত্যকর্মকে কমবেশি প্রভাবিত করে আসছে। প্লেটো দর্শনের দৃষ্টিকোণে কবিতাকে বিবেচনা করেন, তৎকালীন সমাজের সুনীতি ও সরলতার প্রশ্নে ভাবপ্রবণ স্বপ্নাছন্ন কবিদের রাষ্ট্র থেকে বিতারণের কথা বলেন। তাঁর abstract idea/absolute beauty তত্ত্ব, অনুকরণের অনুকরণ মতবাদ ভাবাদী ধারণার পোষক। রাষ্ট্রীয় কাঠামো, স্তরবৈষম্য, ক্ষমতা মতাদর্শের টানাপোড়েন, দার্শনিক তর্ক-প্রতর্ক ইত্যাদির গভীরতল প্লেটোর কাব্য-বিরোধী চেতনায় করেছে। এবং এই ধারণা দিচ্ছে যে, কবিতা প্রথা ও বিদ্যমানতাকে বিচলিত, বিপর্যস্ত করতে সমর্থ অর্থাৎ আমরা প্লেটোর সাহিত্যভাবনায় এটাই পাই যে, কাব্যভাষা প্রথাসম্মত ব্যাকরণিক কাঠামোকে তছনছ করে, সেসঙ্গে রাষ্ট্রকাঠামোকে বিপর্যস্ত করার ঝুকিও তৈরি করে। বিশ শতকের প্রকরণবাদ (Formalism) ও পাঠককেন্দ্রিক সাত্যিতত্ত্বেও (Reader response theory) এ মতেরই বিস্তারণ কি লক্ষ্যযোগ্য নয়? অতীতের তত্ত্বধারার পরস্পরা ও তা লঙ্গনের তাৎপর্যই এখানে স্পষ্ট।
এ সূত্রে আরিস্টটল সবচেয়ে বেশি পরস্পরিত হয়ে ওঠেন বর্তমানের সমালোচনা-তত্ত্বে। অনুকরণ বৃত্তিকে মানুষের সহজাত ক্ষমতা হিসেবে তার স্বীকৃতিদান যেমন একটি বড়ো ঘটনা, তেমনি একথাও প্রাসঙ্গিক ও বৈজ্ঞানিক যে এই অনুকরণ-প্রবৃত্তির মুলে কাজ করে ছন্দ ও সামঞ্জস্য বিধানের
মনুষ্যোচিত প্রবণতা, যদিও তাঁর harmony and rhythmএর নেপথ্যে আছে রাষ্ট্রকাঠামো ও সমাজের সুষম বিন্যাসগত লক্ষ্য, তবুও আরিস্টটলের স্বকীয়ত্ব হল তিনি সাহিত্যশাখাগুলির বস্তুভিত্তিক ব্যাখ্যা দিতে পেরেছিলেন। সাহিত্যে অনুকূত বস্তুর ঐক্য, অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা অনুযায়ী তাদের যথাস্থানে স্থাপনের নির্দেশনা দিয়ে তিনি সমালোচনার ক্ষেত্রে বস্তুভিত্তিক দৃষ্টিভঙ্গির সূত্রপাত ঘটান। তাঁর ব্যাখ্যাত organic form ভাবনাই আজকের সাংগঠনিক সাহিত্যতত্ত্বের (Structuralism) মধ্যে আরো পরিচর্যা ও পরিণতি পেয়েছে। আরিস্টটল দাস প্রধান গ্রিক সমাজে, ভাববাদী প্লেটোর শিষ্য হয়েও জ্ঞানকে বস্তুজগতের বাস্তবভিত্তিতে স্থাপন করতে চেয়েছিলেন। তাঁর বিখ্যাত ক্যাথারসিস তত্ত্বে যে চিত্তশুদ্ধির তাৎপর্য তা বিশেষ পাঠক বা প্রত্যেক পাঠকের চেতনায় শিল্পের উপযোগিতা ও শুভ প্রভাবকেই স্বীকৃতি দেয়। তাঁকে তাই অভিহিত করা যায় সমালোচনা-পদ্ধতির জনক হিসেবে। তাঁর মহাকাব্য ও ট্র্যাজেডির ব্যাখ্যা আজো অ্যাকাডেমিক সাহিত্যপাঠে জরুরি আবশ্যিক হিসেবেই পরিগণ্য। সাহিত্যের সুসংহিত, সুবিন্যাস ও সুমিত গঠনের সঙ্গে দৃশ্যময়তা ও শ্রুতিময়তা যুক্ত করে আরিস্টটল শিল্পসাহিত্যের পরিসীমা বাড়িয়ে দিলেও ঐক্যময়তার বিধানটি ঠিক রাখেন।
আস পোয়েটিকা রচয়িতা রোমান তাত্ত্বিক হোরেসের (খি. পৃ. ৬৫) কৃতিত্ব চিত্রকলার সঙ্গে কাব্যের সুত্র নির্ণয়ে শিল্পীর প্রেরণা ও মেহনতকে প্রাধান্য দেয়া আর শব্দের অর্থব্যঞ্জনা নিয়ে ভাবনার মধ্যেও তিনি সুমিতিবোধকেই মুখ্য করেন। কবিকে অনুধ্যানী হতে বলা তাঁর আরেক অভিনবত্ব। অর্থাৎ সাহিত্য ও রচয়িতা এবং পাঠক-এই ক্রয়ীক্ষেত্রে নিয়ে প্রাচীন সাহিত্য-সমালোচনা-তত্ত্ব বেশি মগ্ন ছিল। রচয়িতার প্রতি নির্দেশ প্রদানে তাঁরা ছিলেন রীতিমতো ওরাকল উচ্চারণকারীর ভূমিকায়। লঙ্গিনুস সাহিত্যকে প্রকাশের মহত্ত্ব দান করে প্লেটোর চিন্তার বিপরীতে যান, যদিও এই মহত্ত্ব রচয়িতা নয় রীতির, বিষয়ের প্রকাশের এবং এসব অর্জনের উপায়ও ব্যাখ্যা করেন। তাঁর স্বকীয়তা হল আটকে নেচার সদৃশ বলে সাব্যস্ত করা। নিসর্গের ভিতরকার পরস্পরা ও বৈচিত্র্যকে আর্ট অনুসরণ করবে, আবিস্কার করবে। এই চিন্তাই পরবর্তী রোম্যান্টিসিজমের মধ্যে পল্পবিতই শুধু নয়, ঐকান্তিক হয়ে উঠেছে। তাঁর Peri hyposis বা On sublime বইটিতে যে সাব্লাইম-অনুভুতি রয়েছে তা পাঠকের অনুভুতিকেও উন্নত করে তাকে নিয়ে যায় রচয়িতার স্তরে। এতো মনে হয় বিশ শতকের তাত্ত্বিক বলা বার্তের লেখকের মৃত্যু পাঠকের জন্ম তত্ত্বের পূর্ববীজ।
গ্রেকো-রোমান ধ্রুপদী সাহিত্য-সমালোচনা তত্ত্বের পথ ধরেই দীর্ঘকাল প্রতীচ্য সাহিত্যরচনাকর্ম বিশ্লেষিত হয়েছে অলংকারের প্রয়োগবিধি ও গুণাগুণ নিয়ে। ভারতীয় সংস্কৃত সাহিত্যভিত্তিক নন্দনতাত্ত্বিকেরাও অলংকার, রীতি-রস-ধ্বনি ইত্যাদি নিয়ে বেশি ব্যস্ত ছিলেন। সমাজ রাষ্ট্রকাঠামোতে সামন্তবাদী মতাদর্শের অপ্রতিহত প্রভাবেই এমনটা ঘটেছে, কারণ এই মতাদর্শ এককেন্দ্রিক, উচ্চমন্যতায় গ্রস্ত এবং স্থিতিশীল কাঠামোতে সুদৃঢ় থেকেছে রেনেসাঁসের পূর্ব-সময় পর্যন্ত। বিষয়, অলংকার ছন্দ কতটা কাব্যশাস্ত্র নির্দেশিত নিয়মগুলির পরিচর্যা করতে পারছে কি পারছে না-সেটাই ছিল সমালোচনার বিষয় আশয়। এমনকি সেন্ট-জাতীয় ধর্মবিদরাও নীতিভ্রষ্ট কাব্যের বিরোধিতা করে মতামতের পাল্লা ভারি করেছেন। যেমন, উল্লেখ করা যায় সেন্ট অগস্টিনের (৩৫৪-৪৩০ খ্রি) মতাদর্শ। তিনি তাঁর ঈশ্বরতত্ত্ব (City of God) তেরো বছর ধরে রচিত) ব্যাখ্যায় নিয়তিবাদকে যেমন প্রাধান্য দিয়েছিলেন তেমনি অ্যাসথেটিকস অর্থাৎ নান্দনিকসত্তা প্রসঙ্গে বিপরীত অবস্থান নিয়েও আসলে সৌন্দর্যতত্ত্ব সম্পর্কেই চিন্তাভাবনা করেছেন। প্রথম জীবনে প্যাগানবাদী ও তীব্র ভোগবাদী হয়েও সেন্ট অগাস্টিন পরবর্তী জীবনে ঈশ্বরের রাজ্য কল্পনার বুঁদ হয়ে থাকেন। এবং কবিতাতত্ত্বকে ঈশ্বরতত্ত্বের মধ্যে আবৃত করে ফেলেন এবং অভিনেতাদের বিপক্ষে অবস্থান গ্রহণ করেন। আরিস্টটল যে অর্থে শিল্পের ক্যাথারসিস দিয়ে ব্যক্তিমনকে শুদ্ধকরার নিদান বাৎলে দেন, অগাস্টিনের বক্তব্য হচ্ছে পাপচেতনা থেকে ব্যক্তি নিজে যুক্তির দায়িত্ব গ্রহণ করবে, শিল্পসাহিত্যের ক্যাথারসিসকে অবিশ্বাস করতে হবে। তাঁর তত্ত্ব আমাদের বড়জোর রহস্যবাদের কাছে নিয়ে যায় যা পরবর্তীকালে ম্যাটাফিজিক্যাল বা মিষ্টিক কবিদের শক্তি ও সমর্থন যুগিয়েছিল। বিশ শতকের প্রতীচ্য সাহিত্যতত্ত্বের ঠিকুজি তৈরিতে আমরা একটি তাৎপর্য চিহ্নিত করতে পারি যে, ধ্রুপদী যুগ বা মধ্যযুগের সমালোচনা সাহিত্য বিনির্মাণে অস্বীকরণে তাত্ত্বিকেরা আসলে ভাষাকে শক্তিশালী ও নান্দনিক গুণে সমৃদ্ধ সমৃদ্ধ করে গেছেন। এবং এই ভাষা ব্যাখ্যাই বর্তমান সমালোচনা তত্ত্বের গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্র।
দুই
রেনেসাঁসের পর্যায় থেকে নতুন দিশা ও পরিসরের বিস্তার শুরু হয় এবং প্রতীচ্য আধুনিক প্যারাডাইমের মধ্যে তা বিশ্বময় আবেষ্টনী তৈরিতে সমর্থ হয়। মানবকেন্দ্রিক যুক্তি আলোকায়ন ইত্যাদি পর্ব-পর্বান্তর সাহিত্য-সমালোচনা তত্ত্বে প্রবেশ করে, এর সঙ্গে জড়িয়ে থাকে বিশ্বের দেশে -দেশে অভিযান, আবিস্কার, সংস্কৃতির দৈশিক-আঞ্চলিক রূপগুলিকে আত্তীকরণ, বিজ্ঞান-প্রযুক্তির উৎকর্ষিত বস্তুসম্পদ কেন্দ্রিক দৃষ্টিভঙ্গি ও জীবনকে তন্ন তন্ন করে ভাগে-উপভাগে নিরীক্ষণের নানা প্রয়াস। এবং এশিয়া আফ্রিকা লাতিন আমেরিকায় উপনিবেশ স্থাপনের মধ্য দিয়ে ইংরেজি ভাষার প্রচার-প্রসার, বাইবেলীয় সভ্যতা প্যারাডাইমের শিকড়ায়ন এবং সম্পদ লুণ্ঠন। ইতোমধ্যে গ্রিক-লাতিন ভাষার পরিবর্তে বিভিন্ন আঞ্চলিক ভাষাগুলি লিখনক্রিয়ায় প্রবিষ্ট হতে থাকে। এবং আগেই উল্লেখ করা হয়েছে যে, ইংরেজি ভাষার কবলে উপনিবেশিত দেশগুলি নিজেদের চেতনাকে সমর্পিত করতে বাধ্য হয় সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক হোজিমনির কারণে, ইংরেজি ভাষায় শিক্ষা গ্রহণের বাস্তবতায় যার মুল রশিটা ছিল উপনিবেশে প্রভুত্ববাদের ও ক্ষমতায়নের হাতে। তখন থেকেই সাহিত্য-সমালোচনা তত্ত্বের রপ্তানি বাণিজ্যের শরু।
মনীষা ও ইতিহাসে মাহেন্দ্রক্ষণ যেমন আছে তেমনি আছে যুগস্রষ্টা অনেক প্রতিভাবর্গের আবির্ভাবও, কখনো একঝাক জ্ঞানজীবী মিলে তত্ত্ব-নির্মাণের কাজটা করেন, কখনো বা একজনই নিয়ন্ত্রণ করেন গোটা শতাব্দীর মনন ও সূজনজগৎকে। রেনেসাঁসের গর্তে লুকানো অভিযান স্পৃহা-চৈতন্য ও শারীরিক দুই অর্থেই, থেকেই আবিস্কৃত ও যোগসুত্র গড়ে ওঠে। গ্রেকোরোমান সাহিত্যচিন্তার সঙ্গে, সেগুলির প্রাসঙ্গিক ও নবায়ন-লক্ষ্যে আসে নিও-ক্লাসিসিজন নব্য ধ্রুপদীবাদ যা একইসঙ্গে ওই রোম্যান্টিসিজমের ভাবালুতা ও আভিশষ্যের বিরুদ্ধে একটি প্রতিরোধ ব্যবস্থা হিসেবে। ফ্রান্সের তাত্ত্বিক বোয়ালের মতে, শক্তিশালী সমালোচক তিনিই যিনি নব্য ধ্রুপদীবাদকে পুনরায় লিপিবদ্ধ ও সংযত করেন কতিপায় বিধিবিধানে। এরাই হলেন ইয়োরোপের আলেকজান্ডার পোপ, ড্রাইডেন ফিলিপ সিডনি, ত্রিসিনো, বেনি, তাশো স্যামুয়েল জনসন প্রমুখ। যুক্তিবাদ আর প্রযুক্তির কলকব্জার ঠিকঠাক সংস্থান একে অন্যের সঙ্গে যুক্ততার বন্ধন ইত্যাকার বস্তুগত প্রতিক্রিয়ায় নব্যধ্রুপদীবাদ সাহিত্য রচনার কতিপয় শর্ত ও সূত্র বিধিবদ্ধ করে দেয়। কারণ ব্যক্তি-স্বাধীনতার প্রসার, দেশে
দেশে বাণিজ্য বিস্তারের মধ্যদিয়ে ব্যক্তির ধনবৃদ্ধি ও তা রাজনৈতিক ক্ষমতালিপ্সায় পর্যাবসান আর রাজতন্ত্র-গির্জার বিপরীতে রাষ্ট্রের ক্ষমতায়ন–এসব কারণ মিলেমিশে ওইসব শর্ত ও সূত্র দিয়ে সমাজকে সংহত ও স্থিরতর করতে চেয়েছিল। শেক্সপীয়রের ট্রাজিক নাটকগুলি এই প্রেক্ষাপটেরই উৎসারণ আবার তার অন্তর্ঘাতকও বটে যা অধুনা আবিষ্কার করা যাচ্ছে মনোবিশ্লেষণ পদ্ধতিতে নারীবাদী দৃষ্টিকোণে, এমনকি সাংগঠনিক সাহিত্যতত্ত্ব দিয়েও।
চৌদ্দ থেকে আঠার শক পর্যন্ত আমরা বিজ্ঞান-দর্শন ও সমাজতত্ত্বের ক্ষেত্রে বিপুল পরিবর্তন শুধু নয়, লক্ষ করি এসব তত্ত্ব দিয়ে সাহিত্যতত্ত্ব নির্মাণ ও নির্ধারণের ক্ষেত্রে সরাসরি হস্তক্ষেপ। জ্ঞান যেমন নিজেই একটা শক্তি নেতনি ভাষা ও স্বয়ং প্রতীক যা বাস্তবকে সৃষ্টি করে, ধারণ করে, গোপন রাখে আবার উন্মোচনও করে। তাই জ্ঞানজীবীরাই সাহিত্যভাষায় প্রতীকগুলি তৈরি করে দেন, বিশেষ করে অধিভাষ্য সৃষ্টি করেন ধর্ম-দর্শন-পূরাণ দিয়ে, শব্দপ্রতিমাকে চক্ষুদান করেঁ। সাহিত্য সমালোচনা তত্ত্ব এই ক্রিয়াশীলতার বহির্ভুত নয় তা আমরা প্লেটো আরিস্টটলের আলোচনায় বলেছি। উক্ত অধিভাষা বিশ শতকের প্রথমার্ধ পর্যন্ত সমালোচনাতত্ত্বকে নিয়ন্ত্রণ করেছে যার বিরুদ্ধে দাঁড়ান ফ্রান্সের তাত্ত্বিক ক্যাক দেরিদা, এর আগে যেটি লক্ষ করা যায় জার্মানির নাট্যকার কবি ব্রেখটের এপিক থিয়েটার ও এলিয়েনেশন এফেক্ট তত্ত্বে। সেখানে আরিস্টটলের ভীতি-করুণ রসের তত্ত্ব বা বলা চলে সাহিত্যতত্ত্বের সমানুভূতি ধারণাটি (empathetic concept) ভেঙে দিয়ে দর্শক-পাঠককে রীতিমতো বিশ্লেষণকারীতে উত্তীর্ণ করান। বস্তুত, সমালোচনা বা সাহিত্য ব্যখার ইতিহাস সর্বদাই মুক্ত দিগন্তাভিসারী হয়ে থিয়োরিকে ক্রমান্বয়ে নিয়ে যেতে চেয়েছে প্রথাগত বৃত্তের বাইরে। আর এই প্রয়াসের পেছনে কাজ করেছে নানা সংস্কৃতিক মিথস্ক্রিয়া, আঞ্চলিক সাহিত্যগুলির বিকাশ, এমনকি ওরাল লিটারেচারের আঙ্গিকও, অর্থাৎ সমাজপরিধি যতবেশি বহুচারিতায়, প্রসারণশীলতায় ও বিকেন্দ্রিতায় গেছে ততবেশি সাহিত্যতত্ত্ব ‘শত ঝর্নার জলধ্বনি’ হয়ে উঠেছে। যে সমাজ যতবেশি বৌদ্ধিকতায় সৃজনক্ষমতার মিথস্ক্রিয়া ঘটাতে পেরেছে সে সমাজে ততবেমি থিয়োরির জঙ্গমতা তৈরি হয়েছে। সৌন্দর্যতত্ত্ব, সাহিত্যের উপযোগিতা কী এ নিয়ে বহুমতামত, প্রকৃতিচেতনার প্রয়োগ, সর্বোপরি বিভিন্ন শিল্পশাখার মধ্যে পরস্পর সংযোগ সৃষ্টি ইত্যকার বৈশিষ্ট্য রোম্যান্টিক সাহিত্যতত্ত্বের কল্পনাশক্তির শক্তিবত্তা নিয়ে প্রবল হতে থাকে। কান্ট,শিলার, লেসিং-এর Art for art sake তত্ত্ব যেমন ঘোষণা করে শিল্পকর্ম হবে শুদ্ধ ও নির্লিপ্ত, তেমিন গ্যাটে বলেন শিল্প মাত্রে স্বাধনি সৃষ্টি। ১৮৩৫-এ গোতিয়ে লেখেন যে সৌন্দর্যসৃষ্টি ছাড়া আর্টের বাকি উদ্দেশ্য অস্বীকৃত হবে। একঝাঁক রোম্যান্টিক কবি শেলী কীটস বায়রন ওয়ার্ডসওয়ার্থ কোলরিজ, সত্য-সুন্দরকে একেবারে অধিভাষিক করে তোলেন, সার্বজনীন ও সর্বজনীন অর্থে, যার প্রভাব-প্রেরণা রবীন্দ্রনাথেরও শনাক্তযোগ্য। রেনেসাঁস যে মানবকে কেন্দ্র রেখে অভিযাত্রা শুরু করেছিল, রোমান্টিকতা সেখানে তুঙ্গরূপ দিল ব্যক্তিবাদকে, ব্যক্তির ইমাজিনেশন ক্ষমতাকে করে তুললো সার্বভৌম এবং সাহিত্যের অধিশ্বর। এই কল্পনা ও অধিভাষিক প্রতীতি আধুনিকতার প্রতিষ্ঠাতা কবি টি এস এলিয়টের নিতান্তই অপ্রিয় ছিল, কারণ ব্যক্তিবাদ ও কল্পনার আতিশয্য কাব্যকে বাস্তবতা থেকে দূরে সরিয়ে নিচ্ছিল এবং কাব্যকে করে তুলেছিল কবিমুখচ্ছদে আবৃত। তিনি এর পরিবর্তে ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যকে এবং লেখা থেকে লেখকের পলায়নকে প্রতিষ্ঠা দিতে চেয়েছিলেন।
রোম্যান্টিক সমালোচনাতত্ত্বের একঘেয়িমি ও ভাবালুতা থেকে আত্মরক্ষার নিদানরূপে এল বাস্তববাদ, বহু জটিলতায় আকীর্ণ শিল্পবিপ্লবোত্তর শ্রেণিস্তরিক সমাজের অন্তশ্চাপে। কিন্তু এতত্ত্বে বাস্তবের অবিকল উপস্থাপনা যা ন্যাচারালিজম, কিংবা বাস্তবের সমালোচনা যাকে বলা হয় ক্রিটিক্যাল রিয়ালিজম ও সমাজতান্ত্রিক বাস্তবতা যা এই সমাজব্যবস্থা থেকে উত্তরণের স্বপ্ন দেখিয়েছিল সবাই ছিল সাহিত্যে কী রূপায়িত হবে, কীভাবে হবে, মানুষের মুক্তির দিশা দেবে কীনা–ইত্যকার প্রশ্নের উত্তর সন্ধান-চেষ্টা। কিন্তু এই তত্ত্ব ভাষার কাঠামো নিয়ে ভাবেনি যে, ভাষা উক্ত বাস্তবতার নির্ণায়ক, ধারক ও সংরক্ষক। তবু, বলা চলে সাহিত্যে রিয়েলিজদের চর্চা বিশেষত গদ্য সাহিত্যে সমালোচনা তত্ত্বের পরবর্তী পর্বগুলির তথা মার্কসবাদ ফ্রয়েডিজম ইতিহাসবাদ ইত্যাদির বীজতলা হয়ে উঠেছিল।
রোম্যান্টিক সমালোচনাতত্ত্বের একঘেয়িমি ও ভাবালুতা থেকে আত্মরক্ষার নিদানরূপে এল বাস্তববাদ, বহু জটিলতায় আকীর্ণ শিল্পবিপ্লবোত্তর শ্রেণিস্তরিক সমাজের অন্তশ্চাপে। কিন্তু এতত্ত্বে বাস্তবের অবিকল উপস্থাপনা যা ন্যাচারালিজম, কিংবা বাস্তবের সমালোচনা যাকে বলা হয় ক্রিটিক্যাল রিয়ালিজম ও সমাজতান্ত্রিক বাস্তবতা যা এই সমাজব্যবস্থা থেকে উত্তরণের স্বপ্ন দেখিয়েছিল সবাই ছিল সাহিত্যে কী রূপায়িত হবে, কীভাবে হবে, মানুষের মুক্তির দিশা দেবে কীনা–ইত্যকার প্রশ্নের উত্তর সন্ধান-চেষ্টা। কিন্তু এই তত্ত্ব ভাষার কাঠামো নিয়ে ভাবেনি যে, ভাষা উক্ত বাস্তবতার নির্ণায়ক, ধারক ও সংরক্ষক। তবু, বলা চলে সাহিত্যে রিয়েলিজদের চর্চা বিশেষত গদ্য সাহিত্যে সমালোচনা তত্ত্বের পরবর্তী পর্বগুলির তথা মার্কসবাদ ফ্রয়েডিজম ইতিহাসবাদ ইত্যাদির বীজতলা হয়ে উঠেছিল।
তিন
ইতোমধ্যে নগরের প্রসারণ ও শহরের ব্যাপক স্ফীতি, বিত্তধারী ও বিত্তহীনদের মধ্যে বৈষম্যপূর্ণ অবস্থা ও অবস্থান, প্রযুক্তি শিল্পের চমৎকারিত্ব ও অতিবিকাশ এবং উৎপাদন-পদ্ধতির নিত্যনতুন পরিবর্তন ও তাতে মানুষের সম্পর্কগুলির দ্রুত ভাঙন-বিবর্তন-মিথস্ক্রিয়া– এরকম অনেকান্ত কার্যকারণের ইয়োরোপের জীবনকাঠামো জঙ্গমরূপ নেয়। আর অন্যদিকে তাদের উপনিবেশিগুলি স্বাধীনতা অর্জনের লক্ষ্যে আন্দোলন সংগ্রামে প্রবল হয়ে উঠতে থাকে। আশংকা দেখা দেয় সম্পদ লুণ্ঠনের অবসান নিয়ে উপনিবেশে নিয়োজিত পুঁজির নিরাপত্তা নিয়েও উদ্বেগ জাগে এবং রাষ্ট্রীয় ঐক্যবিনষ্টির, প্রতিষ্ঠানের শক্তিহ্রাসের অবস্থা দৃশ্যমান হতে থাকে। সাহিত্য-সমালোচনার ক্ষেত্রে কী দেখা দেয়? প্রথমত, রাষ্ট্র আর নিরাপত্তা-স্বাচ্ছন্দ্যের ধারক-বাহক হতে পারছে না বিধায় শিল্পী-সাহিত্যিক ছোটে ছোটে গন্ডিতে আত্মরক্ষার ব্রতে অবতীর্ণ হন। এক একটা ইজমের দুর্গে শিল্পকে রক্ষায় তৎপরতা দেখান। শুরুটা বোদলেয়ার মালার্মে-ভ্যালেরির প্রতীকবাদ(Symbolism) দিয়ে এবং পরপর অনেকগুলি ইজমের আবির্ভাব ঘটতে থাকে। এসব মিলিয়ে মর্হার্নিজম নিয়ে বিতর্ক ও সিদ্ধান্ত আজো বিশ্বের দেশে-দেশে সমালোচক মহলে বিরাজমান। রোম্যান্টিকদের বিশ্ববিস্তারী কল্পনাকুশল জীবনরচনার প্রতিপাদ্য থেকে সরে এসে এসব ইজমযুক্ত আধুনিকতা এক-একটা তত্ত্ব হাজির করতে থাকে নন্দনতত্ত্বের মোড়কে। যেগুলোকে মনে হয় শিল্পী-সাহিত্যিকের চমৎকার মনন ও সৃজনক্ষমতা টইটুম্বুর, যেগুলো সমালোচকদের বোধমেধায় ও জ্ঞানকে তুখোড় করে তোলার দাবি জানাতে থাকে। ইজমগুলি ছিল শিল্পী-সাহিত্যিকদের এক-একটি অস্ত্র যা কখনো রঙ-আলো-শব্দ, কখনো বা প্রচল ছন্দ-প্রকরণরীতি তছনছ করে নিজেদের মুক্ত রাখার প্রয়াস চালিয়েছে, প্রকারান্তরে সামাজিক বিধিবিধানের ভাষাকে আক্রমণ করতে চেয়েছে। কৌতুককর বিষয় হল, এসব ইজম-প্রবক্তা ও চর্চাকারীরা অপছন্দের বাস্তব থেকে সরে গিয়ে প্রকৃতিকে অস্বীকার করে মনোগহ্বরে লুকানো প্রতীককে (যা ফ্রয়েডের আবিষ্কার), অস্তিত্বহীন বাস্তবতা সৃষ্টি যেমন মালামেঁ, কিংবা অতীন্দ্রিয় জাদুবাস্তবতায় চলে গিয়ে মেন ভ্যালেরি, আঁকড়ে দরে লড়তে চেয়েছিলেন আসলে বস্তুজগতের বিরুদ্ধের যাকে তাঁরা নিজেদের মনমতো বদলাবার চিন্তাটা করেননি মার্কস-এঙ্গেলসের মতো। ফলে তাঁরা যতটা আত্মরক্ষা বা শিল্পত্ব রক্ষা করছেন বলে ভাবা হয়, তার চেয়ে কম চিহ্নিত করা হয় ওইসব ইজম সাহিত্য-সমালোচনায় কেন কোনো প্যারাডাইম শিফটিং ঘটাতে পারেনি। ১৯০১ সালে বেনেদিত্তো ক্রোচের Aesthetic প্রকাশিত হয় যা রিয়েলিজমকে বাদ দিয়ে সৌন্দর্যের প্রকাশতাত্মক তত্ত্ব হাজির করেছিল ও এর দ্বারা ইজমতত্ত্ব কমবেশি প্রভাবিত হয়। যেমন কুৎসিত ও অসুন্দরতা অসুস্থতা, বিকার-বিকৃতি, যৌনতার গ্লানি– ইত্যাকার কাব্যবিরোধী বিষয়ের গভীরতল থেকে সৌন্দর্যের ফুল ফোটানোর আভীপ্সাই বোদলেয়ারকে সঞ্চালিত করেছিল। বলা বাহুল্য, যেহেতু বিষয়কে ছাড়িয়ে, কখনো ভাঙচুর ঘটিয়ে সৃষ্টি সৃষ্টি করা হয়েছিল সৌন্দর্য তাই এখানে ভরকেন্দ্রটি ছিল প্রকরণ নিষ্ঠতা, প্রযুক্তিপণ্যের উৎপাদনের মতো নিত্যনবীন প্রকরণের উৎসারণ ঘটানো। এই প্রকরণচর্চা থেকেই জন্ম নিয়েছে পরবর্তী কালের রুশ প্রকরণবাদ। এবং বিশ শতকের সাহিত্য-সমালোচনাতত্ত্বের যা আমাদের বর্তমান গ্রন্থে সংকলিত।
ইতোমধ্যে নগরের প্রসারণ ও শহরের ব্যাপক স্ফীতি, বিত্তধারী ও বিত্তহীনদের মধ্যে বৈষম্যপূর্ণ অবস্থা ও অবস্থান, প্রযুক্তি শিল্পের চমৎকারিত্ব ও অতিবিকাশ এবং উৎপাদন-পদ্ধতির নিত্যনতুন পরিবর্তন ও তাতে মানুষের সম্পর্কগুলির দ্রুত ভাঙন-বিবর্তন-মিথস্ক্রিয়া– এরকম অনেকান্ত কার্যকারণের ইয়োরোপের জীবনকাঠামো জঙ্গমরূপ নেয়। আর অন্যদিকে তাদের উপনিবেশিগুলি স্বাধীনতা অর্জনের লক্ষ্যে আন্দোলন সংগ্রামে প্রবল হয়ে উঠতে থাকে। আশংকা দেখা দেয় সম্পদ লুণ্ঠনের অবসান নিয়ে উপনিবেশে নিয়োজিত পুঁজির নিরাপত্তা নিয়েও উদ্বেগ জাগে এবং রাষ্ট্রীয় ঐক্যবিনষ্টির, প্রতিষ্ঠানের শক্তিহ্রাসের অবস্থা দৃশ্যমান হতে থাকে। সাহিত্য-সমালোচনার ক্ষেত্রে কী দেখা দেয়? প্রথমত, রাষ্ট্র আর নিরাপত্তা-স্বাচ্ছন্দ্যের ধারক-বাহক হতে পারছে না বিধায় শিল্পী-সাহিত্যিক ছোটে ছোটে গন্ডিতে আত্মরক্ষার ব্রতে অবতীর্ণ হন। এক একটা ইজমের দুর্গে শিল্পকে রক্ষায় তৎপরতা দেখান। শুরুটা বোদলেয়ার মালার্মে-ভ্যালেরির প্রতীকবাদ(Symbolism) দিয়ে এবং পরপর অনেকগুলি ইজমের আবির্ভাব ঘটতে থাকে। এসব মিলিয়ে মর্হার্নিজম নিয়ে বিতর্ক ও সিদ্ধান্ত আজো বিশ্বের দেশে-দেশে সমালোচক মহলে বিরাজমান। রোম্যান্টিকদের বিশ্ববিস্তারী কল্পনাকুশল জীবনরচনার প্রতিপাদ্য থেকে সরে এসে এসব ইজমযুক্ত আধুনিকতা এক-একটা তত্ত্ব হাজির করতে থাকে নন্দনতত্ত্বের মোড়কে। যেগুলোকে মনে হয় শিল্পী-সাহিত্যিকের চমৎকার মনন ও সৃজনক্ষমতা টইটুম্বুর, যেগুলো সমালোচকদের বোধমেধায় ও জ্ঞানকে তুখোড় করে তোলার দাবি জানাতে থাকে। ইজমগুলি ছিল শিল্পী-সাহিত্যিকদের এক-একটি অস্ত্র যা কখনো রঙ-আলো-শব্দ, কখনো বা প্রচল ছন্দ-প্রকরণরীতি তছনছ করে নিজেদের মুক্ত রাখার প্রয়াস চালিয়েছে, প্রকারান্তরে সামাজিক বিধিবিধানের ভাষাকে আক্রমণ করতে চেয়েছে। কৌতুককর বিষয় হল, এসব ইজম-প্রবক্তা ও চর্চাকারীরা অপছন্দের বাস্তব থেকে সরে গিয়ে প্রকৃতিকে অস্বীকার করে মনোগহ্বরে লুকানো প্রতীককে (যা ফ্রয়েডের আবিষ্কার), অস্তিত্বহীন বাস্তবতা সৃষ্টি যেমন মালামেঁ, কিংবা অতীন্দ্রিয় জাদুবাস্তবতায় চলে গিয়ে মেন ভ্যালেরি, আঁকড়ে দরে লড়তে চেয়েছিলেন আসলে বস্তুজগতের বিরুদ্ধের যাকে তাঁরা নিজেদের মনমতো বদলাবার চিন্তাটা করেননি মার্কস-এঙ্গেলসের মতো। ফলে তাঁরা যতটা আত্মরক্ষা বা শিল্পত্ব রক্ষা করছেন বলে ভাবা হয়, তার চেয়ে কম চিহ্নিত করা হয় ওইসব ইজম সাহিত্য-সমালোচনায় কেন কোনো প্যারাডাইম শিফটিং ঘটাতে পারেনি। ১৯০১ সালে বেনেদিত্তো ক্রোচের Aesthetic প্রকাশিত হয় যা রিয়েলিজমকে বাদ দিয়ে সৌন্দর্যের প্রকাশতাত্মক তত্ত্ব হাজির করেছিল ও এর দ্বারা ইজমতত্ত্ব কমবেশি প্রভাবিত হয়। যেমন কুৎসিত ও অসুন্দরতা অসুস্থতা, বিকার-বিকৃতি, যৌনতার গ্লানি– ইত্যাকার কাব্যবিরোধী বিষয়ের গভীরতল থেকে সৌন্দর্যের ফুল ফোটানোর আভীপ্সাই বোদলেয়ারকে সঞ্চালিত করেছিল। বলা বাহুল্য, যেহেতু বিষয়কে ছাড়িয়ে, কখনো ভাঙচুর ঘটিয়ে সৃষ্টি সৃষ্টি করা হয়েছিল সৌন্দর্য তাই এখানে ভরকেন্দ্রটি ছিল প্রকরণ নিষ্ঠতা, প্রযুক্তিপণ্যের উৎপাদনের মতো নিত্যনবীন প্রকরণের উৎসারণ ঘটানো। এই প্রকরণচর্চা থেকেই জন্ম নিয়েছে পরবর্তী কালের রুশ প্রকরণবাদ। এবং বিশ শতকের সাহিত্য-সমালোচনাতত্ত্বের যা আমাদের বর্তমান গ্রন্থে সংকলিত।
চার
ইজমগুলির ইশতেহার আধুনিকাতার ভিত্তিকে শুধু দেশে-দেশে শিকড়ায়িতই করেনি, খোদ ইয়োরোপেই ভিক্টোরিয়ান সমালোচকদের ধারণায় কুঠারাঘাত করেছিল। আমাদের বাংলা সাহিত্যেও রাবীন্দ্রিক-নান্দনিকতার বিপরীতে এই শিকড়ায়নের গভীর প্রবাব ছিল এবং আজও প্রাকরণিক আলোচনা বিশেষ করে অ্যাকাডেমিক কাব্যালোচনায় এগুলিই বারংবার অনুসন্ধেয় হয় বিবেচ্যও হয়। কিন্তু ইয়োরোপের প্রথম মহাযুদ্ধের আগে -পরে-অন্তত অর্থনৈতিক মহামন্দা পর্যন্ত ইজমের প্রতাপ শিল্পীদের আত্মরক্ষার শিখ-ী হলেও পরবর্তী সময়ে তার বিকাশ ক্রমশ রুদ্ধ হতে শুরু করে। রুশ প্রকরণবাদ দাঁড় করায় কাব্য-গদ্যশিল্প পাঠের বা ব্যাখ্যার গাণিতিক পদ্ধতিতুল্য নতুন সাহিত্যতত্ত্ব। এর তাত্ত্বিকেরা নিজেদের অবশ্য প্রকরণবাদী বলতে নারাজ, এই অভিধাটি দিয়েছেন প্রকরণবিরোধীরা। বিশ শতকের শুরুর দিকে তত্ত্বটির আবির্ভাব যার প্রকৃত নাম হওয়া বাঞ্ছনীয় ‘স্বাতন্ত্র্যবাদ বা বিশেষায়ণবাদ’ (Specifier) । নামে কিবা আসে যায়, তবে এঁরা যে স্বাতন্ত্র্য ও বিশেষায়ণকেই প্রতিষ্ঠা দিতে চেয়েছিলেন রাশিয়ার সমাজতান্ত্রিক ভাবাদর্শের একীকরণবাদের বিরুদ্ধে তা স্পষ্ট। অন্তত সমাজতান্ত্রিক সাহিত্যধারার বক্তব্যপ্রাধান্য ও বাস্তববাদের বিপরীতে তাঁরা ক্ষুদ্র একটি দুর্গ গড়তে চেয়েছিলেন। পরিবর্তন ও স্বাতন্ত্র্য তৈরির সূত্রে এই তত্ত্বে Contact ও Form সাহিত্যের এই চিরাচরিত দ্বৈততাকে তাঁরা নাম দেন Material এবং Device আধার-আধেয়ের চিন্তায় এতদিন আধেয় ছিল উচ্চ বা প্রথম আধার এই আধেয়ার ধারণকারী হিসেবে দ্বিতীয়। কিন্তু প্রকরণাবাদে তৈরি হল প্রাকরণিক কয়েকটি সূত্র যাদের বলা হয় কৃত-করণকলা। সমাজতান্ত্রিক চিন্তায়। শিল্পীর ব্যক্তিত্ব নিরাকৃত করা হয় বলেই প্রাকরণিক বিশেষত্বকে মুখ্য অবস্থানে প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছে এই সাহিত্যতত্ত্ব। অপরিচিতিকরণ (Defamiliarization) , পুরোভূমিকরণ (Foregrouning), এবং এই দুইয়ের যোজনায় সৃষ্ট সাহিত্যগুণ বিশ্লেষণই এখানে বিবেচ্য। সাহিত্যের বাষাকে ব্যবহারিক ভাষা থেকে পৃথক করার সঙ্গেÑসঙ্গে এই তত্ত্ব বিষয়কে নয়– নির্মাণরীতিকে প্রাধান্য দেয়। এই নির্মাণরীতি এমন যে তা অন্যান্য সাহিত্যের সঙ্গে বৈপরীত্য নির্ধারণ করে দেয়। বোঝা যায়, সমাজতান্ত্রিক সাহিত্যরীতির সঙ্গে পার্থক্য বা তাকে অস্বীকার করাই এই তত্ত্ববিদদের লক্ষ্য ছিল। তবে ব্যাকরণিক ভাষাকে লঙ্ঘন করে, বিপর্যস্ত করে, অপরিচিত করেই যে নান্দনিক জগৎ বিনির্মিত হয় প্রকরণবাদ সে সূত্রটি প্রতিষ্ঠিত করতে পেরেছে। রচনা যতই তত্ত্বানুসারী ওজনদার হোক না কেন সাহিত্যগুণ থাকাটা অপরিহার্য। আরেকটি তাৎপর্য লক্ষ্যযোগ্য যে এখানে রচয়িতার ব্যক্তিত্ব অস্বীকার করা হয়, কবিতা বা শিল্পের সঙ্গে রচয়িতার সম্পর্কেও পরিহার করে এই তত্ত্বও, তাঁদের ভাবা নয় কারিগর হিসেবে। এবং সাহিত্য মাত্রেই নতুন সৃষ্টি তা পরস্পরা পূর্ববর্তী ও পরবর্তীর সেতুবন্ধ নয়, বাস্তবতার বিনির্মাণ নয়, নয় ঐতিহ্যের ধারাবাহিকতা। বোধকরি তৎকালীন মার্কসীয় সাহিত্যতত্ত্বে রচয়িতার শ্রেণীচরিত্রকে গুরুত্বপূর্ণ ভাবার বিধি নিয়মকে বাতিল করার লক্ষ্যে এরকম নিরঞ্জন সাহিত্যগুণের ভাবনা প্রবল
ইজমগুলির ইশতেহার আধুনিকাতার ভিত্তিকে শুধু দেশে-দেশে শিকড়ায়িতই করেনি, খোদ ইয়োরোপেই ভিক্টোরিয়ান সমালোচকদের ধারণায় কুঠারাঘাত করেছিল। আমাদের বাংলা সাহিত্যেও রাবীন্দ্রিক-নান্দনিকতার বিপরীতে এই শিকড়ায়নের গভীর প্রবাব ছিল এবং আজও প্রাকরণিক আলোচনা বিশেষ করে অ্যাকাডেমিক কাব্যালোচনায় এগুলিই বারংবার অনুসন্ধেয় হয় বিবেচ্যও হয়। কিন্তু ইয়োরোপের প্রথম মহাযুদ্ধের আগে -পরে-অন্তত অর্থনৈতিক মহামন্দা পর্যন্ত ইজমের প্রতাপ শিল্পীদের আত্মরক্ষার শিখ-ী হলেও পরবর্তী সময়ে তার বিকাশ ক্রমশ রুদ্ধ হতে শুরু করে। রুশ প্রকরণবাদ দাঁড় করায় কাব্য-গদ্যশিল্প পাঠের বা ব্যাখ্যার গাণিতিক পদ্ধতিতুল্য নতুন সাহিত্যতত্ত্ব। এর তাত্ত্বিকেরা নিজেদের অবশ্য প্রকরণবাদী বলতে নারাজ, এই অভিধাটি দিয়েছেন প্রকরণবিরোধীরা। বিশ শতকের শুরুর দিকে তত্ত্বটির আবির্ভাব যার প্রকৃত নাম হওয়া বাঞ্ছনীয় ‘স্বাতন্ত্র্যবাদ বা বিশেষায়ণবাদ’ (Specifier) । নামে কিবা আসে যায়, তবে এঁরা যে স্বাতন্ত্র্য ও বিশেষায়ণকেই প্রতিষ্ঠা দিতে চেয়েছিলেন রাশিয়ার সমাজতান্ত্রিক ভাবাদর্শের একীকরণবাদের বিরুদ্ধে তা স্পষ্ট। অন্তত সমাজতান্ত্রিক সাহিত্যধারার বক্তব্যপ্রাধান্য ও বাস্তববাদের বিপরীতে তাঁরা ক্ষুদ্র একটি দুর্গ গড়তে চেয়েছিলেন। পরিবর্তন ও স্বাতন্ত্র্য তৈরির সূত্রে এই তত্ত্বে Contact ও Form সাহিত্যের এই চিরাচরিত দ্বৈততাকে তাঁরা নাম দেন Material এবং Device আধার-আধেয়ের চিন্তায় এতদিন আধেয় ছিল উচ্চ বা প্রথম আধার এই আধেয়ার ধারণকারী হিসেবে দ্বিতীয়। কিন্তু প্রকরণাবাদে তৈরি হল প্রাকরণিক কয়েকটি সূত্র যাদের বলা হয় কৃত-করণকলা। সমাজতান্ত্রিক চিন্তায়। শিল্পীর ব্যক্তিত্ব নিরাকৃত করা হয় বলেই প্রাকরণিক বিশেষত্বকে মুখ্য অবস্থানে প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছে এই সাহিত্যতত্ত্ব। অপরিচিতিকরণ (Defamiliarization) , পুরোভূমিকরণ (Foregrouning), এবং এই দুইয়ের যোজনায় সৃষ্ট সাহিত্যগুণ বিশ্লেষণই এখানে বিবেচ্য। সাহিত্যের বাষাকে ব্যবহারিক ভাষা থেকে পৃথক করার সঙ্গেÑসঙ্গে এই তত্ত্ব বিষয়কে নয়– নির্মাণরীতিকে প্রাধান্য দেয়। এই নির্মাণরীতি এমন যে তা অন্যান্য সাহিত্যের সঙ্গে বৈপরীত্য নির্ধারণ করে দেয়। বোঝা যায়, সমাজতান্ত্রিক সাহিত্যরীতির সঙ্গে পার্থক্য বা তাকে অস্বীকার করাই এই তত্ত্ববিদদের লক্ষ্য ছিল। তবে ব্যাকরণিক ভাষাকে লঙ্ঘন করে, বিপর্যস্ত করে, অপরিচিত করেই যে নান্দনিক জগৎ বিনির্মিত হয় প্রকরণবাদ সে সূত্রটি প্রতিষ্ঠিত করতে পেরেছে। রচনা যতই তত্ত্বানুসারী ওজনদার হোক না কেন সাহিত্যগুণ থাকাটা অপরিহার্য। আরেকটি তাৎপর্য লক্ষ্যযোগ্য যে এখানে রচয়িতার ব্যক্তিত্ব অস্বীকার করা হয়, কবিতা বা শিল্পের সঙ্গে রচয়িতার সম্পর্কেও পরিহার করে এই তত্ত্বও, তাঁদের ভাবা নয় কারিগর হিসেবে। এবং সাহিত্য মাত্রেই নতুন সৃষ্টি তা পরস্পরা পূর্ববর্তী ও পরবর্তীর সেতুবন্ধ নয়, বাস্তবতার বিনির্মাণ নয়, নয় ঐতিহ্যের ধারাবাহিকতা। বোধকরি তৎকালীন মার্কসীয় সাহিত্যতত্ত্বে রচয়িতার শ্রেণীচরিত্রকে গুরুত্বপূর্ণ ভাবার বিধি নিয়মকে বাতিল করার লক্ষ্যে এরকম নিরঞ্জন সাহিত্যগুণের ভাবনা প্রবল
হয়েছে। পরবর্তীকালের সাংগঠনিক(Structuralistic) ও উত্তর সাংগঠনিক (PostStructuralistic) প্রবক্তারাও লেখককেন্দ্রিকতা নস্যাৎ করেন। কিন্তু স্তালিনের নির্দেশে এই তাত্ত্বিকদের গড়ে-তোলা চর্চাকেন্দ্র বন্ধ হয়ে যায়। প্রকরণবাদী রোমান ইয়াকবসন মস্কো থেকে প্রাগে চলে যাওয়ায় এই সাহিত্যতত্ত্ব আর পরিচর্ষিত হয়নি। তবে ভবিষ্যৎপ্রসারী হয়ে অন্যান্য সাহিত্যতত্ত্বকে প্রেরণাদীপ্ত করেছে, যেমন নিউ ক্রিটিসিজমকে বা দেরিদার ডিকনস্ট্রাকশন অর্থাৎ অবিনির্মাণকে। তবে প্রকরণবাদে ভাষাকে কেন্দ্রীয় অবস্থান দিলেও বাস্তবতা, ইতিহাস ইত্যাদি সম্পর্কে ধারণা বাদ দিয়েছিল, সমাজ বিষয়েও ছিল উদাসীন। তাঁদের ভাষাজ্ঞানও খুববেশি বিজ্ঞানসম্মত ছিল না যা পরবর্তী ভাষাভিত্তিক সাহিত্যতত্ত্বে সম্পূর্ণতা পেয়েছে। তীব্রভাবে ‘সাহিত্যপর’ হওয়াটাও আরেক ব্যর্থতা– মিখাইল বাখতিনের সমালোচনায় যে সামাজিক ও মতাদর্শিক ধারণা তার ধারে কাছেও প্রকরণবাদ যায়নি।
বিশ শতকের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ তত্ত্ব তৈরি হয় ভাষাবিজ্ঞানের হাত ধরে, যাকে বলতে পারি ভাষাভিত্তিক সাহিত্যতত্ত্ব। এ যেন এক উৎসকেন্দ্র যা থেকে উৎসারিত হয়েছে অন্যান্য সাহিত্য সমালোচনা তত্ত্ব। ভাষাবিজ্ঞান মূলক্ষেত্র হেতু তত্ত্বটি বিভিন্ন জ্ঞানকা- ব্যাখ্যারও হাতিয়ার হয়ে উঠেছে। আধুনিক সাহিত্য ভাষার ব্যবহার যতকিছু নিরীক্ষা করেছে, শব্দের ভাঙচুর ঘটিয়ে, সীমা বাড়িয়ে-কমিয়ে ভেতরকাঠামোকে (inner-reality) খুঁড়তে চেয়েছে সেইসব ভাষাভিত্তিক সাহিত্যতত্ত্বে জড়ো হয়েছে, আলোচিত-সমালোচিত হয়েছে কিন্তু ভিন্ন ব্যাখ্যায়, ভিন্ন তাৎপর্যে। উনিশ শতকের শেষের দিকে ভাষাবিজ্ঞানীদের চর্চিত যে ধারণা সেটি ছিল ভাষা পরিবর্তনের প্রক্রিয়াটিকে আবিষ্কার করার লক্ষ্যতাড়িত। কিন্তু বিশ শতকে ভাষাগত পৃথক একটি ধারণা গভীর ও প্রবাবশালী হয়ে সাহিত্যের ভাষাকেই শুধু নয়, সাহিত্যের প্রকৃতি, গঠন, রীতি, সমাজ-সংস্কৃতি-সবকিছুকে নিজের আওতায় নিয়ে আসে। এমনকি বিভিন্ন ‘শাখা-প্রশাখার জীবন-দর্শন ও দার্শনিক তত্ত্বগুলিকেও। আগে ভাবা হত ভাষার মাধ্যমে বস্তুসম্পর্কিত ধারণা প্রতিফলিত হয়, শব্দই ব্রহ্ম, সমস্ত অর্থ ধারণ করে; আমরা সহজেই এই অর্থ পাই আর সাহিত্য ছিল ‘জীবনার্থের রূপক’, জীবন এখানে উপস্থিাপিত যা বুঝে নেয়া যায়।
বিশ শতকের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ তত্ত্ব তৈরি হয় ভাষাবিজ্ঞানের হাত ধরে, যাকে বলতে পারি ভাষাভিত্তিক সাহিত্যতত্ত্ব। এ যেন এক উৎসকেন্দ্র যা থেকে উৎসারিত হয়েছে অন্যান্য সাহিত্য সমালোচনা তত্ত্ব। ভাষাবিজ্ঞান মূলক্ষেত্র হেতু তত্ত্বটি বিভিন্ন জ্ঞানকা- ব্যাখ্যারও হাতিয়ার হয়ে উঠেছে। আধুনিক সাহিত্য ভাষার ব্যবহার যতকিছু নিরীক্ষা করেছে, শব্দের ভাঙচুর ঘটিয়ে, সীমা বাড়িয়ে-কমিয়ে ভেতরকাঠামোকে (inner-reality) খুঁড়তে চেয়েছে সেইসব ভাষাভিত্তিক সাহিত্যতত্ত্বে জড়ো হয়েছে, আলোচিত-সমালোচিত হয়েছে কিন্তু ভিন্ন ব্যাখ্যায়, ভিন্ন তাৎপর্যে। উনিশ শতকের শেষের দিকে ভাষাবিজ্ঞানীদের চর্চিত যে ধারণা সেটি ছিল ভাষা পরিবর্তনের প্রক্রিয়াটিকে আবিষ্কার করার লক্ষ্যতাড়িত। কিন্তু বিশ শতকে ভাষাগত পৃথক একটি ধারণা গভীর ও প্রবাবশালী হয়ে সাহিত্যের ভাষাকেই শুধু নয়, সাহিত্যের প্রকৃতি, গঠন, রীতি, সমাজ-সংস্কৃতি-সবকিছুকে নিজের আওতায় নিয়ে আসে। এমনকি বিভিন্ন ‘শাখা-প্রশাখার জীবন-দর্শন ও দার্শনিক তত্ত্বগুলিকেও। আগে ভাবা হত ভাষার মাধ্যমে বস্তুসম্পর্কিত ধারণা প্রতিফলিত হয়, শব্দই ব্রহ্ম, সমস্ত অর্থ ধারণ করে; আমরা সহজেই এই অর্থ পাই আর সাহিত্য ছিল ‘জীবনার্থের রূপক’, জীবন এখানে উপস্থিাপিত যা বুঝে নেয়া যায়।
কিন্তু ফরাসি ভাষাবিজ্ঞানী ফার্দিনান্দ দ্য সোসুর (১৮৫৭-১৯১৩) এর মতে ভাষা কোনোকিছুর প্রতীক বা অনুকৃতি হয়। ভাষা স্বয়ং একটি পদ্ধতি যার আছে নিজস্ব নিয়ম ও চিহ্ন। তিনি ভাষাকাঠামোর দ্যোতক বা চিহ্ন এবং দ্যোতিত বা চিহ্নায়ক–এভাবে ভাগ করলেন। দ্যোতক হচ্ছে ধ্বনিরূপ (Signifier) আর দ্যোতনা(Signified) হচ্ছে অর্থ। দ্যোতক বস্তুকে নির্দেশ করে না, ধারণাকে নির্দেশ করে। ভাষা বাস্তবকে মূর্ত করে ভাষা নিজেই একটা প্রতীক আমাদের অভিজ্ঞতা ও ধারণাকে আকারিত ও কাঠামোবদ্ধ করে। ভাষাচিন্তার ক্ষেত্রে বিশ শতকের ইলেকট্রনিক প্রযুক্তির প্রভাব গভীর, যোগাযোগের নতুন-নতুন পদ্ধতি আবিষ্কারের ফলে ভাষার ক্ষেত্রে প্রবল হয়েছে ওই প্রতীক ও পদ্ধতিগত আলোচনা ব্যাখ্যা এবং উদ্ভব ঘটিয়েছে ভাষাভিত্তিক সাহিত্যতত্ত্বের। সোসুর ভাষাকে বললেন স্বশাসিত, স্বেচ্ছাচারী (Arbitary) ও পার্থক্যকারী বা প্রভেদক চিহ্ন। আমরা কোনো শব্দকে চিহ্নিত করি অন্য শব্দের সঙ্গে তার পার্থক্য থেকে, ‘অন্তর্নিহিত গুণাবলী থেকে নয়।’ যেমন ‘বই’ এই ধ্বনিকে বুঝে নিই ‘খই, ‘সই’–এরকম ধ্বনির সঙ্গে পার্থক্য নির্দেশ করার মধ্য দিয়ে। অর্থাৎ সোসুলের বক্তব্য হচ্ছে ভাষাকে জানতে হলে এরকম চিহ্নের আন্তর-সম্পর্ককে বুঝতে হবে, তার মৃঙ্খলাকে অনুধাবন করতে হবে, কারণ ভাষা বিচ্ছিন্ন ঘটনা বা বস্তুর পি- নয়, বরং ভাষার একটি উপাদান আরেকটির সঙ্গে বা সমগ্র কাঠামোর সঙ্গে তার অবস্থান দ্বারা সংবদ্ধ। সোসুর Langue ও Parole নামে আরো দুটি উপাদানের কথা বলেন। এবং দুটির মধ্যে সূক্ষ্ম পার্থক্য চিহ্নিত করেন। ভাষার ভেতর শৃঙ্খলা হচ্ছে লগ আর প্যারোল হচ্ছে ব্যক্তির উচ্চারণÑক্রিয়া প্যারোলকে নয় সোসুর লগের মধ্যেই বাষার ভূমিকাকে নির্দেশ করেন। অর্থাৎ নানাবিধ প্রভেদের মধ্য দিয়ে ভাষাকাঠামোকে দাঁড় করাবার এই প্রয়াস ভেঙে দিয়েছিল ভাষানির্ভর সাহিত্যব্যাখ্যার ঐক্যবন্ধ বিন্যাসমূলক পদ্ধতিকে। এরকম আরো প্রভেদের উল্লেখ করা যায় যেমন Synchronic ও Dischronic যথাক্রমে সংকালিক ও কালানুক্রমিকের প্রভেদ, Paradigmatic ও associative–পদরূপ–মূল ও আনুষঙ্গিকের মধ্যে পার্থক্য ইত্যাদি। পদরূপমূলের ভিত্তি হচ্ছে পদের ব্যাকরণিক আদর্শ, যা যোগাযোগের জন্য ক্রমানুসারে সাজানো হয়; কিন্তু আনুষঙ্গিক সম্পর্ক ছাড়া আমরা ভাষাকে বুঝবনা। ‘গাছটি সবুজ ছিল’– বাক্যের অনুষঙ্গে আসতে পারে গাছগুলি, জোপঝাড়, গুল্ম, লতা ইত্যাদির সঙ্গে পার্থক্য অর্থাৎ বাক্য বা শব্দ শুধু ক্রিয়া, বিশেষ্য, বিশেষণ ইত্যাদির রূপ ধারণ করে না। একইসঙ্গে অনুপস্থিত অনুষঙ্গগুলিকেও প্রভেদকরূপে ধারণ করে। এই যে অনুষঙ্গের অনুপস্থিতি এটাই দেরিদার বিনির্মাণ তত্ত্বে ডিফারেন্স রূপে বিকশিত হয়েছে। সোসুর ভাষা ও বাস্তবতার মধ্যে পার্থক্য বা বিচ্ছেদবিন্দু দেখিয়ে দিয়ে সাংগঠনিক (Structuralist) তত্ত্বের প্রাথমিক ভিত্তি তৈরি করে দেন যেখানে মানবিক সকল ক্রিয়াকর্ম সবধরণের তাৎপর্য নিয়ে বস্তুজগৎ থেকে স্বাধীন হয়ে যায়। বস্তুত এখান থেকেই উৎপত্তি ঘটে ইয়াকবসনের ভাষিক কাব্যতত্ত্ব, রিফাতারের শৈলীতত্ত্ব, এমনকি লেভি স্ট্রসের সাংগঠনিক মিথতত্ত্ব ইত্যাদি আরো সাহিত্য তত্ত্ব।
পাঁচ
প্রতীচ্যের রেনেসাঁস বা আধুনিকবাদ উপনিবেশে রপ্তানি করা হলেও তা বৈশিক বা স্থানিক রঙরূপ ধারণ করেছিল। বুর্জোয়া ধনতান্ত্রিক সমাজের প্রগতিশীল ধারা হিসেবে যে মার্কসবাদকে ইতিহাসে স্থান দেয়া হয়েছে তাও অবিকল থাকেনি। মার্কসের নামে ‘সাহিত্যের সমাজতত্ত্ব’ সংজ্ঞায়নটি পরিচিতি পেলেও তাঁর সমালোচনা-তত্ত্ব এই সংখ্যায় সীমাবদ্ধ থাকেনি। এর মধ্যে তত্ত্ব ও অনুশীলনের যৌগপদ্য ছিল আবশ্যকীয় সূত্র, ফলে প্রতীচ্যের জন্যে যেমনটি উপযুক্ত তেমন করেই ব্যাখ্যা করা হয়েছে এবং নানা প্রতর্ক, সূত্র ও স্কুল গড়ে উঠেছে, ভেঙেছেও বারবার। পরীক্ষিত হয়েছে সমাজ রাষ্ট্রের, শ্রেণী ও ক্ষমতার দ্বন্দ্ব-সংঘাতের প্রেক্ষাপটে। এ তত্ত্বের বিশ্লেষণ করেছেন যেমন মাকর্সিস্ট লেখক-সমাজবিদরা তেমনি করেছেন অন্য ধরানার নন্দনতাত্ত্বিকেরাও। তাতেই বিপুল ও বিচিত্র রূপ ধারণ করেছে মার্কসীয় নন্দনতত্ত্ব।
একটি বিষয় স্পষ্ট হওয়া বাঞ্ছনীয় যে মার্কসবাদ আধুনিক চেতনারই এক প্রগতিশীল ধারা হিসেবে ধর্তব্য যা আধুনিকতার (High modernism) উচ্চ ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যকে ধ্বংস করতে চেয়েছে, একই সময়ে এরকমটি করেছেন মনস্তত্ত্ববিদ সিগমু- ফ্রয়েডও। আমরা এই তত্ত্বে শেষ পর্যন্ত পাই একটি দেকার ভঙ্গি আয়ত্ত করা, চেতনাগত করা ও বিশ্ববীক্ষা গড়ে তোলার প্যারাডাইম। যেমন বলা চলে ১৮৬৩ সালেই প্রকাশিত তেমনই রচিত History of English Literature গ্রন্থে যে ইতিহাস ব্যাখ্যা রয়েছে তা মার্কসীয় সাহিত্য সমালোচনায়ও আছে। কিন্তু মার্কসীয় তত্ত্বের মৌলিকত্ব হল। ঐতিহাসিক দৃষ্টিভঙ্গির গ্রন্থনা নয়, ইতিহাসের বৈপ্লবিক ব্যাখ্যাপ্রদান। কারণ জগৎকে বর্ণনা করা নয়, একে বদলে দেয়াই মার্কসীয় ঐতিহাসিক দ্বান্দ্বিক বস্তুবাদী জীবনদর্শনের প্রোগ্রাম।
এই সাহিত্যতত্ত্বের প্রথম পর্বের গুরুত্বপূর্ণ তাত্ত্বিক হলেন গেওর্গ লুকাচ, তিনি বাস্তববাদের ব্যাখ্যায় প্রতিফলন তত্ত্বের প্রয়োগ ঘটান। লেককের শ্রেণী-অবস্থান, মতাদর্শের বিভিন্ন ধরন এবং সাহিত্যের বহুবিধ ধরণের সঙ্গে তাদের সম্পর্ক, সাহিত্যসৃষ্টির বিভিন্ন কলাকৌশল, ইত্যাদি সমাবেশকেই এই তত্ত্বে ‘শিল্প’ বলা হয়েছে। এদের প্রত্যেকটির আপেক্ষিক স্বাতন্ত্র্য আছে, তবে শিল্প মতাদর্শগত সংকটের ফসল নয়, বরং সংকটকে বিশ্বজনীন ভাষায় রূপান্তরিত করে যাতে তাকে শাশ্বত মানবিক পরিস্থিতি বলে উপলব্ধি করা সম্ভব হয়। প্রাচীন মিশরীয় শিল্প থেকে আধুনিক মানুষ পর্যন্ত সমানভাবে যার অংশীদার’। আমরা লুসিত্র গোল্ডম্যান, পিয়ের মাশরি, ওয়াল্টার বেঞ্জামিন, ব্রেশট, কডওয়েল, জর্জ টমসন, রেমন্ড উইলিয়ামস, সমালোচনা-তত্ত্বকে সমৃদ্ধ করেছেন। এঁরা শিল্পসাহিত্যকে একান্তিক ও শ্রেষ্ঠতম স্থানে দাঁড় করাননি, তাঁদের মতে, সাহিত্যের স্থান বিজ্ঞান ও মতাদর্শের মাঝামাঝি কোথাও। সাহিত্য আমাদের বৈজ্ঞানিক জ্ঞান দেয় না। কিন্তু তার সাহায্যে বাস্তবতা সম্পর্কে বিজ্ঞানদৃষ্টি লাভ করা যায়, এই দৃষ্টি দিয়ে কোনো কিছুকে অনুভব করতে শেখায়। আলতুৎসেরের মতে, যে-কোনো সাহিত্যেই এই কোনো, কিছু হচ্ছে মতাদর্শ যার থেকে এই সাহিত্যের উৎপত্তি, যার মধ্যে সাহিত্যটি নিমজ্জিত থাকে আবার একইসঙ্গে নিজেকে বিচ্যুতও করে। এই দৃষ্টিভঙ্গি দিয়ে সমালোচনা করা হলে তা শুধু মতাদর্শকেই স্পষ্ট করে না, বুঝিয়ে দেয় বাবনা, মূল্যবোধ, অনুভবকেও। এবং অবশ্যই এসব থেকে উৎসারিত বাগরীতিকে, কৃৎকলাকে, এমনকি ছন্দকে পর্যন্ত বোধ্য করে। এ সূত্রেই আরো লক্ষ্যযোগ্য, বিশ শতকে উদ্ভূত ফেনোমেনোলজি, হার্মেনিউটিকস, রিস্পেশন থিওরি, স্ট্রাকচারালিজম, ফেমিনিজম, সাইকোঅ্যানালিটিক্যাল থিয়োরি– ইত্যাকার, তত্ত্বের সঙ্গে মাকর্সীয় সাহিত্যবীক্ষা কোথাও সহযাত্রী, কোথাও বিরোধী। এর আছে সেই নমনীয় গুণ যা সর্বত্রই অপর তত্ত্ব তেকে শিক্ষা নিয়ে নিজেকে সমৃদ্ধকরণে উৎসাহী। আলতুৎসের এটাই বোঝাতে চান যে, সাহিত্যের ব্যাখ্যায় মতাদর্শকে বোঝার তাৎপর্যই হল অতীত ও বর্তমানকে গভীরভাবে বুঝে নেয়া, সেই বোদ গড়ে নেয়া যা আমাদের মানবিক মুক্তির সহায়ক হতে পারে।
এ-সূত্রে রাশিয়ার তাত্ত্বিক মিখাইল বাখতিনের সমালোচনা-তত্ত্বের কথা বলতেই হয়। প্রতীচ্য সমালোচনা-পরস্পরা, নান্দনিক জিজ্ঞাসা ও সমাজবদলের প্রসঙ্গকে তিনি সমাজতাত্ত্বিক পোয়েটিকসে অন্বিত করে, বিশেস করে ইয়োরোপীয় আধুনিকতার ক্রিটিক হয়ে উঠেন। এটাই তাঁর ডায়ালজ্জিম যা প্রতীচ্যের কর্তৃত্বকে চ্যালেঞ্জ করে, টেক্সটের ওপরে কনটেক্সটকে প্রাধান্য দেয় যাতে এসে যায় বহু কিছু সামাজিক-ঐতিহাসিক, জলবায়ুগত, শারীরিকতা মিলে মিশে সকল পরিস্থিতি। তাঁর তত্ত্ব এসূত্রে গুরুত্ব দেয় বহুস্বরিকতা, কানির্ভাল, নভেলাইজেশান ক্রিয়াশীলতাকে।
তবে মাকর্সবাদ উৎপাদন শক্তি, উৎপাদন-পদ্ধতি ও উৎপাদন সম্পর্কের বিশ্লেষণকে যেবাবে ব্যাখ্যা করে সেখানে অনুপস্থিতি থাকে মানবমনের গতিপ্রকৃতি, যদিও মানবমনকেও শ্রেণীর প্রতিফলন হিসেবেই দেখা হয়ে থাকে। এক্ষেত্রে, বা প্রায় পিঠাপিঠি আবির্ভূত হলেন ফ্রয়েড তাঁর মনস্তাত্ত্বিক ব্যাখ্যা নিয়ে, তারপর একে একে য়ুং, অ্যাডলার, পাভলভ, এরিক ফ্রম প্রমুখের পরবর্তী সময়ে লাঁকা স্ব-স্ব ব্যাখ্যা নিয়ে মনস্তাত্ত্বিক সাহিত্য-সমালোচনা তত্ত্বকে প্রবল করে
পাঁচ
প্রতীচ্যের রেনেসাঁস বা আধুনিকবাদ উপনিবেশে রপ্তানি করা হলেও তা বৈশিক বা স্থানিক রঙরূপ ধারণ করেছিল। বুর্জোয়া ধনতান্ত্রিক সমাজের প্রগতিশীল ধারা হিসেবে যে মার্কসবাদকে ইতিহাসে স্থান দেয়া হয়েছে তাও অবিকল থাকেনি। মার্কসের নামে ‘সাহিত্যের সমাজতত্ত্ব’ সংজ্ঞায়নটি পরিচিতি পেলেও তাঁর সমালোচনা-তত্ত্ব এই সংখ্যায় সীমাবদ্ধ থাকেনি। এর মধ্যে তত্ত্ব ও অনুশীলনের যৌগপদ্য ছিল আবশ্যকীয় সূত্র, ফলে প্রতীচ্যের জন্যে যেমনটি উপযুক্ত তেমন করেই ব্যাখ্যা করা হয়েছে এবং নানা প্রতর্ক, সূত্র ও স্কুল গড়ে উঠেছে, ভেঙেছেও বারবার। পরীক্ষিত হয়েছে সমাজ রাষ্ট্রের, শ্রেণী ও ক্ষমতার দ্বন্দ্ব-সংঘাতের প্রেক্ষাপটে। এ তত্ত্বের বিশ্লেষণ করেছেন যেমন মাকর্সিস্ট লেখক-সমাজবিদরা তেমনি করেছেন অন্য ধরানার নন্দনতাত্ত্বিকেরাও। তাতেই বিপুল ও বিচিত্র রূপ ধারণ করেছে মার্কসীয় নন্দনতত্ত্ব।
একটি বিষয় স্পষ্ট হওয়া বাঞ্ছনীয় যে মার্কসবাদ আধুনিক চেতনারই এক প্রগতিশীল ধারা হিসেবে ধর্তব্য যা আধুনিকতার (High modernism) উচ্চ ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যকে ধ্বংস করতে চেয়েছে, একই সময়ে এরকমটি করেছেন মনস্তত্ত্ববিদ সিগমু- ফ্রয়েডও। আমরা এই তত্ত্বে শেষ পর্যন্ত পাই একটি দেকার ভঙ্গি আয়ত্ত করা, চেতনাগত করা ও বিশ্ববীক্ষা গড়ে তোলার প্যারাডাইম। যেমন বলা চলে ১৮৬৩ সালেই প্রকাশিত তেমনই রচিত History of English Literature গ্রন্থে যে ইতিহাস ব্যাখ্যা রয়েছে তা মার্কসীয় সাহিত্য সমালোচনায়ও আছে। কিন্তু মার্কসীয় তত্ত্বের মৌলিকত্ব হল। ঐতিহাসিক দৃষ্টিভঙ্গির গ্রন্থনা নয়, ইতিহাসের বৈপ্লবিক ব্যাখ্যাপ্রদান। কারণ জগৎকে বর্ণনা করা নয়, একে বদলে দেয়াই মার্কসীয় ঐতিহাসিক দ্বান্দ্বিক বস্তুবাদী জীবনদর্শনের প্রোগ্রাম।
এই সাহিত্যতত্ত্বের প্রথম পর্বের গুরুত্বপূর্ণ তাত্ত্বিক হলেন গেওর্গ লুকাচ, তিনি বাস্তববাদের ব্যাখ্যায় প্রতিফলন তত্ত্বের প্রয়োগ ঘটান। লেককের শ্রেণী-অবস্থান, মতাদর্শের বিভিন্ন ধরন এবং সাহিত্যের বহুবিধ ধরণের সঙ্গে তাদের সম্পর্ক, সাহিত্যসৃষ্টির বিভিন্ন কলাকৌশল, ইত্যাদি সমাবেশকেই এই তত্ত্বে ‘শিল্প’ বলা হয়েছে। এদের প্রত্যেকটির আপেক্ষিক স্বাতন্ত্র্য আছে, তবে শিল্প মতাদর্শগত সংকটের ফসল নয়, বরং সংকটকে বিশ্বজনীন ভাষায় রূপান্তরিত করে যাতে তাকে শাশ্বত মানবিক পরিস্থিতি বলে উপলব্ধি করা সম্ভব হয়। প্রাচীন মিশরীয় শিল্প থেকে আধুনিক মানুষ পর্যন্ত সমানভাবে যার অংশীদার’। আমরা লুসিত্র গোল্ডম্যান, পিয়ের মাশরি, ওয়াল্টার বেঞ্জামিন, ব্রেশট, কডওয়েল, জর্জ টমসন, রেমন্ড উইলিয়ামস, সমালোচনা-তত্ত্বকে সমৃদ্ধ করেছেন। এঁরা শিল্পসাহিত্যকে একান্তিক ও শ্রেষ্ঠতম স্থানে দাঁড় করাননি, তাঁদের মতে, সাহিত্যের স্থান বিজ্ঞান ও মতাদর্শের মাঝামাঝি কোথাও। সাহিত্য আমাদের বৈজ্ঞানিক জ্ঞান দেয় না। কিন্তু তার সাহায্যে বাস্তবতা সম্পর্কে বিজ্ঞানদৃষ্টি লাভ করা যায়, এই দৃষ্টি দিয়ে কোনো কিছুকে অনুভব করতে শেখায়। আলতুৎসেরের মতে, যে-কোনো সাহিত্যেই এই কোনো, কিছু হচ্ছে মতাদর্শ যার থেকে এই সাহিত্যের উৎপত্তি, যার মধ্যে সাহিত্যটি নিমজ্জিত থাকে আবার একইসঙ্গে নিজেকে বিচ্যুতও করে। এই দৃষ্টিভঙ্গি দিয়ে সমালোচনা করা হলে তা শুধু মতাদর্শকেই স্পষ্ট করে না, বুঝিয়ে দেয় বাবনা, মূল্যবোধ, অনুভবকেও। এবং অবশ্যই এসব থেকে উৎসারিত বাগরীতিকে, কৃৎকলাকে, এমনকি ছন্দকে পর্যন্ত বোধ্য করে। এ সূত্রেই আরো লক্ষ্যযোগ্য, বিশ শতকে উদ্ভূত ফেনোমেনোলজি, হার্মেনিউটিকস, রিস্পেশন থিওরি, স্ট্রাকচারালিজম, ফেমিনিজম, সাইকোঅ্যানালিটিক্যাল থিয়োরি– ইত্যাকার, তত্ত্বের সঙ্গে মাকর্সীয় সাহিত্যবীক্ষা কোথাও সহযাত্রী, কোথাও বিরোধী। এর আছে সেই নমনীয় গুণ যা সর্বত্রই অপর তত্ত্ব তেকে শিক্ষা নিয়ে নিজেকে সমৃদ্ধকরণে উৎসাহী। আলতুৎসের এটাই বোঝাতে চান যে, সাহিত্যের ব্যাখ্যায় মতাদর্শকে বোঝার তাৎপর্যই হল অতীত ও বর্তমানকে গভীরভাবে বুঝে নেয়া, সেই বোদ গড়ে নেয়া যা আমাদের মানবিক মুক্তির সহায়ক হতে পারে।
এ-সূত্রে রাশিয়ার তাত্ত্বিক মিখাইল বাখতিনের সমালোচনা-তত্ত্বের কথা বলতেই হয়। প্রতীচ্য সমালোচনা-পরস্পরা, নান্দনিক জিজ্ঞাসা ও সমাজবদলের প্রসঙ্গকে তিনি সমাজতাত্ত্বিক পোয়েটিকসে অন্বিত করে, বিশেস করে ইয়োরোপীয় আধুনিকতার ক্রিটিক হয়ে উঠেন। এটাই তাঁর ডায়ালজ্জিম যা প্রতীচ্যের কর্তৃত্বকে চ্যালেঞ্জ করে, টেক্সটের ওপরে কনটেক্সটকে প্রাধান্য দেয় যাতে এসে যায় বহু কিছু সামাজিক-ঐতিহাসিক, জলবায়ুগত, শারীরিকতা মিলে মিশে সকল পরিস্থিতি। তাঁর তত্ত্ব এসূত্রে গুরুত্ব দেয় বহুস্বরিকতা, কানির্ভাল, নভেলাইজেশান ক্রিয়াশীলতাকে।
তবে মাকর্সবাদ উৎপাদন শক্তি, উৎপাদন-পদ্ধতি ও উৎপাদন সম্পর্কের বিশ্লেষণকে যেবাবে ব্যাখ্যা করে সেখানে অনুপস্থিতি থাকে মানবমনের গতিপ্রকৃতি, যদিও মানবমনকেও শ্রেণীর প্রতিফলন হিসেবেই দেখা হয়ে থাকে। এক্ষেত্রে, বা প্রায় পিঠাপিঠি আবির্ভূত হলেন ফ্রয়েড তাঁর মনস্তাত্ত্বিক ব্যাখ্যা নিয়ে, তারপর একে একে য়ুং, অ্যাডলার, পাভলভ, এরিক ফ্রম প্রমুখের পরবর্তী সময়ে লাঁকা স্ব-স্ব ব্যাখ্যা নিয়ে মনস্তাত্ত্বিক সাহিত্য-সমালোচনা তত্ত্বকে প্রবল করে
তোলেন। প্রবৃত্তি-চালিত অবচেতন, কন্ডিশন রিফ্লেকস বা যৌথ পদ্ধতির অবচেতনের সূত্রে ব্যাখ্যাত হতে থাকে সাহিত্য-শিল্পকলা এবং জন্ম দেয় প্রভাবসঞ্চারকারী পরাবাস্তববাদী ব্রহ্মন্ড-বিস্তারী মানবের বহির্জাতিক জ্ঞানকা- বিজ্ঞান দিয়ে যতদূর যাচ্ছে, মনসস্তত্ত্ববাদ মানবমনের গভীরে ততবেশি প্রবিষ্ট হতে চাইতে কিন্তু মন সরহহসস্যমময় ও অব্যাখ্যাত সাবজেকটিভ ব্যাপার যাকে তত্ত্বের কাঠামোতে বাধা যায় না, এ দুর্বলতা দূর করার প্রয়াস লক্ষণীয় লাঁকার মনস্তাত্ত্বিক দর্শনে। পূর্বসূরিদের বাদ দিয়ে নয়, তিনি ফ্রয়েডের অবচেচতন, আনুষঙ্গিক ভাষাবিজ্ঞান ও ক্লদ লেভি স্ট্রসের নৃতত্ত্ব জ্ঞানকান্ড দিয়ে নিজের দর্শনকে শকক্ত ভিত্তির ওপর দাঁড় করাতে চেয়েছেন। ফ্রয়েড যেখানে বলেন যে, অবচেতন ব্যক্তিগত ও তা ব্যক্তির অবদমিমত প্রবৃত্তি-তা মানুষের ভেতরে থাকে, লাকাঁর মতে এই অবচেচতন না ভাষার দ্বারা গঠিত, মনস্তাত্ত্বিক সংকট ব্যক্তিগত নয়, তা প্রাথমিক অবস্থায় ইতিহাসিত-Events are engendered in a primary horizen লাকাঁর বক্তব্য হচেচ্্ছ, অবচেতন অন্যের ভাষা, তা নানারকম বিধিনিষেধ, প্রত্যয়রূপে ব্যক্তির জন্মের আগেই সমাজে রয়েছে, এবং তা রয়েছে ভাষা স্তরেরর মধ্যে। ফলে ফ্রয়েডের ভেতর কাঠামো থেকে লাকাঁর উত্তরণ ঘটে বাইরের ভাষাঠাকামোতে। বসস্তুত, মার্কসবাদ যেমন উনিশ শতকীয় বুজেয়ায়া ব্যক্তি ব্যক্তিবাদ ধ্বংস করে শ্রেণীস্বার্থ উৎপাটিত করতে চেয়েছে, মনস্তাত্ত্বিক বিদ্যাও চেয়েছে ব্যক্তির নিরঙ্কুশ স্বাধীনতা কল্পনাশক্তিকে বাদ দিয়ে মনের নব্বইভাগ অংশস্বরূপ অবচেতন ক্ষমতার প্রাধান্য প্রতিষ্ঠা করতে। তেমনি আধুনিক পুঁজিবাদী প্রতীচ্যে বিচ্ছিন্ন শ্রম, ভোগ-সবর্স্বতা, যে কোনো বস্তুকে বিক্রয়যোগ্য পণ্যে রূপান্তরকরণ ইত্যাদির সঙ্গে লাকাঁর দর্শনের একটা সংযোগ আবিষ্কার করা দুরূহ নয়। যেমন, তাঁর তত্ত্বে বিচ্ছিন্নতার বহুবিধ লীলা এবং সেসঙ্গে অন্যের উপস্থিতি বিদ্যমান। তবে এই ‘অন্য’ যে কে বা কারা তার কোনো সীমারেখা নেই, বরং সীমারেখা ভেঙে দেয়াই লাকাঁর লক্ষ্য। এই ‘অন্য’কে আমরা আরেক তাৎপর্যে দেখতে পাই ‘অপরতা’ ভাবনায় উত্তর উপনিবেশবাদী তত্ত্বে। যা রাজনৈতিক, শ্রেণীস্তরিক হলেও মনস্তাত্ত্বিক, ভাষিক এবং চিহ্নময়। লাকাঁর ভাবনায় সামাজিক অবস্থার সমালোচনা নেই, সাহিত্যের শ্রমবিচ্ছিন্ন মানুষ ও সমাজচিত্রকে এই তত্ত্ব দিয়ে কতটুকু ধরা যাবে তা বিতর্কসাপেক্ষ। তিনি কোনো ইউটোপিয়া জাতীয় আশাবাদে অবিবশ্বাসী, তাঁর চিন্তায় লিঙ্গ একটি বিমূর্ত প্রতীক, ব্যক্তির অহং ভাষার সৃষ্টি, তা বাস্তব সত্য নয়। ভাষাই বস্তুকে উদ্ভাবন করে, সৃষ্টি করে, অহং বা মনকেও করে।
এসবের পাশাপাশি আবির্ভূত আরেকটি গভীর তত্ত্ব দর্শনতাত্ত্বিক সাহিত্য-সমালোচনা হচ্ছে সার্তের অস্তিত্ববাদ। কিয়ের্কেগ্রাদ, হুর্সাল প্রমুখ অস্তিত্ব সম্পর্কে দার্শনিক ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণের যে ধারা গড়ে তোলেন সার্ত তাকেই পূর্ণতা দেন সাহিত্যতাত্ত্বিক ভাবনাবলি দিয়ে এবং জীবন ও মানুষ সম্পর্কে ভিন্ন অভিমত তুলে ধরে। ঈশ্বর সন্ধানের চেয়ে মানুষের জন্য বেশি প্রয়োজন নিজেকে খোঁজা ও অনুধাবন করা। মানুষ শুধু নিজের ব্যক্তিসত্তার জন্যই দায়ী নয়। পুরো মানবজাতির জন্যই দায়ী, অপরের দায়দায়িত্ব গ্রহণের মধ্যদিয়েই মানুষের অস্তিত্ব পূর্ণতা পায়। নিজের ব্যাখ্যা করে ও একইসঙ্গে অস্তিত্ববাদী দৃষ্টিকোণে সাহিত্যরচনার মধ্য দিয়ে সার্ত সমালোচনা-পদ্ধতির ভিন্ন দিক উন্মোচন করেন। লেখক ও পাঠকের সম্পর্ক নির্ণয়ের প্রশ্নে তাঁর বক্তব্য হল লেখক যে চরিত্র সৃষ্টি করেন তার দ্বারা পাঠক আকৃষ্ট হয় এবং এর দ্বারা লেখকের স্বাধীনতা উদ্বেলিত হয়। কারণ সার্তের দর্শনের মূল কথাই হল মানুষ স্বাধীনতার জন্য দ-প্রাপ্ত। বিপরীত দিকে, লেখক তাঁর সৃষ্টিকর্মের মধ্যেই পাঠকদের অংশগ্রহণের স্বাধীনতার কাছে আবেদন রাখেন। তাঁর মতে, লিখনক্রিয়ার উদ্দেশ্যই হচ্ছে স্বাধীনতার দিগন্ত প্রসারিত করা, ব্যক্তিকে দায়বদ্ধ করা, জগতের পুনর্নবীকরণ করা কীভাবে তা ঘটে ? সার্ত বলেন যে, শিল্পজগৎ যেমন, ঠিক তেমনভাবেই তা পরিবেশিত হয় অথচ দেখায় যেন তা মানুষের স্বাধীনতায় সৃষ্ট, ফলে এই জগৎ পরিবেশনা থেকেই এক নিহিত জগৎ পুনরাবিস্কৃত হয়। এটাই সাহিত্যের শক্তি ও সম্ভবনা এবং লেখকের দায়বদ্ধতা এই পুনরাবিষ্করণে সঙ্গে জড়িত। আর পাঠকের ভূমিকা এখানে আরো ব্যাপক। এই চিন্তাই ক্রমে উত্তরাধুনিক তত্ত্বে পাঠককেন্দ্রিকতায় ঐকান্তিক প্রতিষ্ঠা পায়। বোধকরি এই কারণে যে, পণ্যভোগী বাজার সংস্কৃতিতে যেভাবে পণ্যের মূল্য ক্রেতার চাহিদার ওপর নির্ভরশীল, সেভাবেই সাহিত্যের মূল্যায়নে ভোক্তা-পাঠকের ভূমিকা প্রধান হয়ে উঠে। সার্তের সাহিত্যভাবনায় বাস্তবতা এভাবেই স্বীকৃত হয় এবং সাহিত্যের পঠনপাঠনকে গুরুত্বপূর্ণ ও মননধর্মী করে তোলে।
এ পর্যায়ের পরবর্তী ধাপে ‘অস্তিত্ব’-জিজ্ঞাসার জটিলতার সরণী বেয়েই অ্যাবসার্ড তত্ত্বটি সাহিত্যরচনায়, বিশেষত নাট্যশিল্পে তাৎপর্যবহ হয়ে ওঠে, এবং রচিত হতে থাকে অনেক নাটক। এই তত্ত্বে আরিস্টটলীয় নাট্যকাঠামো ভেঙে দেয়া হয়। চরিত্র-ঘটনা-সংলাপ-পরিণতি ইত্যাদি ঐক্যের বাঁধন কেটে টুকরো-টুকরো হয়ে পড়ে, এবং অর্থশূন্য, নিষ্ক্রিয় ব্যক্তিমানুষকে চিত্রিত করতে থাকে। প্লেটো থেকে সার্তে পর্যন্ত চিন্তার কাঠামোতে যে ডুয়ালিস্টিক বা দ্বৈত রূপ ছিল পাপ/পূণ্য ভাল/মন্দ, শুভ/অশুভ, শোষক/শোষিত, ইত্যাদি ইত্যাদি, তা বর্জিত হয় অ্যাবসার্ড তত্ত্বে। যেহেতু পৃথিবী এখন গল্পহীন, জীবন অর্থহীন, মানুষ অভ্যাসবদ্ধ কর্মের শৃঙ্খলে বাঁধা, তাই পাপ-পুণ্য বা শুভ-অশুভ নিয়ে লড়াই করাও হাস্যকর। এই তত্ত্বের একটি তাৎপর্য পরবর্তী উত্তরাধুনিকতায় পল্লবিত হয়েছে সেটি হল, দ্বৈততা তছনছ করার ফলে বহুত্বের উৎসারণকে প্রসারিত করা সম্ভব হয়েছিল এবং গল্পের বা আশাবাদের যেসব ম্যাটান্যারেটিভের কাঠামোতে মানুষ সংবদ্ধ, আবর্তিত ও সংগ্রামশীল ছিল বা থাকে সেইসব ম্যাটান্যারেটিভকে ধ্বংস ঘোষণায় উদ্বুদ্ধ করেছিল। এ যেন অর্থনীতির মনোপলি বাজার প্রতা ভেঙে বহুজাতিক বাজারব্যবস্থারই সমান্তরাল সাহিত্যিক ধারা এবং বাস্তব অর্থেও তাই ঘটেছে উত্তরাধুনিক তত্ত্বকাঠামোতে, বাজার-অর্থনীতিতে মালিক-উৎপাদক-শ্রমদানকারী-উৎপাদিত পণ্য সবকিছুর আন্তসম্পর্ক আর নির্ধারিত কাঠামোতে দৃশ্যমান নয়, তা মুহূর্মুহূ পরিবর্তিত, অস্থির, কখনোবা অবোধ্য।
ছয়
১৯৬৮ সালের ফ্রান্সের ব্যাপক ছাত্র আন্দোলনের পরবর্তী সময় থেকে আজ পর্যন্ত পৃথিবী এক নতুন খাতে প্রবাহিত হতে থাকে। এতকালের হেলেনিস্টিক সভ্যতা প্রশ্নবিদ্ধ হয়, এমনকি অব্যবহিত পূর্ববর্তী আধুনিকবাদকেও ভাঙচুরেরর সাহিত্যিক-সাংস্কৃতিক আন্দোলন তীব্র হয়ে ওঠে। মার্কসীয় তত্ত্ব জিজ্ঞাসা ও নানা মতে বিভক্তি-বিতর্কায়নের প্রতিষ্ঠান গড়ে ওঠে, আমরা দেখি সত্তরের দশকেই সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র রাশিয়ার পতন এবং পৃথিবী জুড়ে ক্যাপিটালিজমের নানা মূর্তি ও ঢঙের আত্মপ্রকাশ। উপনিবেশিত দেশগুলি স্বাধীন হতে শুরু করেছিল দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর থেকেই। ইতোমধ্যে তাদের জাতীয়তাবোধ ও অর্থনৈতিক পরিকল্পা মোটামুটি গঠমান পর্যায় অতিক্রমে ব্যস্ত ছিল। এই পর্যায়েই উত্তর-উপনিবেশবাদী সাহিত্যতত্ত্বের উদ্ভব যা এশিয়ার ও আফ্রিকা লাতিন আমেরিকার শিল্পসাহিত্য বিশ্লেষণে অত্যন্ত ইতিবাচক প্রস্তাব বিস্তার করে। প্রাচ্য ও অতীচ্যের সেই বিভাজনকে তুলে ধরে যার ভিত্তি ছিল শোষণ-লুণ্ঠন-অত্যাচার ও চৈতন্য দখলের কদর্যতা, এবং পৃথিবীব্যাপী ইংরেজি ভাষার আধিপত্যবাদী শক্তি। উত্তর-উপনিবেশবাদ প্রতীচ্যের রপ্তানি তত্ত্ব তথা আধুনিকবাদকে তীব্রভাবে তদন্ত করে দৈশিক-আঞ্চলিক সাহিত্যকে নতুনভাবে ব্যাখ্যা করে, উন্মোচন করে ভাষার মুখোশ ঢাকা সা¤্রাজ্যবাদের নগ্নরূপ এবং স্ব-স্ব দেশের ঐতিহাসিক ধারার সঙ্গে গড়ে তোলে সংলগ্নতা ও পুনর্জায়মান হয়ে ওঠার বিরহবোধে দগ্ধীভত, দ্রবীভূত হতে থাকে। এই সাহিত্য-সমালোচনাতত্ত্ব দাঁড়িয়ে আছে পৃথিবীব্যাপী সা¤্রাজ্যবাদ প্রতিষ্ঠার ইতিহাসের ওপর, তাই এটি অনুধাবনের ক্ষেত্রে আমাদের ইম্পেরিয়ালিজমকে বুকে নিতে হয়। এর সুদীর্ঘ রাজজনৈতিক-অর্থনৈতিক-সাংস্কৃতিক আধিপত্যবাদের আত্মিক যোগসূত্র চিহ্নিত করা সম্ভব হয় যাচ্ছে। সাহিত্যকে এই তত্ত্বালোকে পাঠ করতে গেলে দ্বিমুখী বৈপরীত্য (Binary opposition)), ভাষিক কাঠামো, মনস্তাত্ত্বিক উপনিবেশবাদ, যাকে বলা যায় কলোনিয়াল লিগ্যাসি ইত্যাদির সরণী বেয়ে পথ চলতে হয়। এডওয়ার্ড সাঈদের ওরিয়েন্টলিজম তত্ত্ব এক্ষেত্রে একটি বড় হাতিয়ার যা দিয়ে প্রাচ্য সম্পর্কে প্রতীচ্যের চেতনার ভেতরকাঠামোতে প্রবেশ করা যায়। অর্থাৎ উত্তর-উপনিবেশিবাদী সাহিত্যতত্ত্ব খোঁড়াখুঁড়ির মধ্যদিয়ে আত্ম-আবিষ্কারের যাত্রা পথটি তৈরি করে দিয়েছে। উপনিবেশিত দেশগুলির সাহিত্য বিশ্লেণের তত্ত্ব হলেও মজার কথা এই যে, তত্ত্বটি এককালের উপনিবেশ-প্রভুদের দেশেই চর্চিত হচ্ছে প্রাতিষ্ঠানিক ভাবেই, ঠিক যেমন পুঁচিবাদী দেশগুলিই মার্কসবাদকে অধিক হারে পরিচর্যা করে থাকে। তবে, এটুকু বলা যায় যে, এশিয়া-আফ্রিকা-লাতিন আমেরিকায় আত্মজাগ্রত লেখক-সমালোচকদের জন্যে এটি সবচেয়ে লাগসই তত্ত্ব হয়ে উঠেছে, উঠছেও তবে, তত্ত্বটি খুববেশি আক্রমণাত্মক, পরিধ্বংসী (Subversive), যার সঙ্গে মিল আছে নারীবাদী সাহিত্যতত্ত্বের। তবে এটি আন্দোলনও বটে, সেই অর্থে গভীর তাৎপর্যবহ যে-অর্থে আমরা লক্ষ করি সাহিত্যতত্ত্বের আন্দোলনই লাতিন আমেরিকার সাহিত্য, ম্যাজিক রিয়েলিজম এবং মার্কেজকে তাৎপর্যবহ করে তুলেছে। উত্তর-উপনিবেশবাদ একঅর্থে সাহিত্য-সমালোচনার চক্ষুদান করেছে।
ছয়
১৯৬৮ সালের ফ্রান্সের ব্যাপক ছাত্র আন্দোলনের পরবর্তী সময় থেকে আজ পর্যন্ত পৃথিবী এক নতুন খাতে প্রবাহিত হতে থাকে। এতকালের হেলেনিস্টিক সভ্যতা প্রশ্নবিদ্ধ হয়, এমনকি অব্যবহিত পূর্ববর্তী আধুনিকবাদকেও ভাঙচুরেরর সাহিত্যিক-সাংস্কৃতিক আন্দোলন তীব্র হয়ে ওঠে। মার্কসীয় তত্ত্ব জিজ্ঞাসা ও নানা মতে বিভক্তি-বিতর্কায়নের প্রতিষ্ঠান গড়ে ওঠে, আমরা দেখি সত্তরের দশকেই সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র রাশিয়ার পতন এবং পৃথিবী জুড়ে ক্যাপিটালিজমের নানা মূর্তি ও ঢঙের আত্মপ্রকাশ। উপনিবেশিত দেশগুলি স্বাধীন হতে শুরু করেছিল দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর থেকেই। ইতোমধ্যে তাদের জাতীয়তাবোধ ও অর্থনৈতিক পরিকল্পা মোটামুটি গঠমান পর্যায় অতিক্রমে ব্যস্ত ছিল। এই পর্যায়েই উত্তর-উপনিবেশবাদী সাহিত্যতত্ত্বের উদ্ভব যা এশিয়ার ও আফ্রিকা লাতিন আমেরিকার শিল্পসাহিত্য বিশ্লেষণে অত্যন্ত ইতিবাচক প্রস্তাব বিস্তার করে। প্রাচ্য ও অতীচ্যের সেই বিভাজনকে তুলে ধরে যার ভিত্তি ছিল শোষণ-লুণ্ঠন-অত্যাচার ও চৈতন্য দখলের কদর্যতা, এবং পৃথিবীব্যাপী ইংরেজি ভাষার আধিপত্যবাদী শক্তি। উত্তর-উপনিবেশবাদ প্রতীচ্যের রপ্তানি তত্ত্ব তথা আধুনিকবাদকে তীব্রভাবে তদন্ত করে দৈশিক-আঞ্চলিক সাহিত্যকে নতুনভাবে ব্যাখ্যা করে, উন্মোচন করে ভাষার মুখোশ ঢাকা সা¤্রাজ্যবাদের নগ্নরূপ এবং স্ব-স্ব দেশের ঐতিহাসিক ধারার সঙ্গে গড়ে তোলে সংলগ্নতা ও পুনর্জায়মান হয়ে ওঠার বিরহবোধে দগ্ধীভত, দ্রবীভূত হতে থাকে। এই সাহিত্য-সমালোচনাতত্ত্ব দাঁড়িয়ে আছে পৃথিবীব্যাপী সা¤্রাজ্যবাদ প্রতিষ্ঠার ইতিহাসের ওপর, তাই এটি অনুধাবনের ক্ষেত্রে আমাদের ইম্পেরিয়ালিজমকে বুকে নিতে হয়। এর সুদীর্ঘ রাজজনৈতিক-অর্থনৈতিক-সাংস্কৃতিক আধিপত্যবাদের আত্মিক যোগসূত্র চিহ্নিত করা সম্ভব হয় যাচ্ছে। সাহিত্যকে এই তত্ত্বালোকে পাঠ করতে গেলে দ্বিমুখী বৈপরীত্য (Binary opposition)), ভাষিক কাঠামো, মনস্তাত্ত্বিক উপনিবেশবাদ, যাকে বলা যায় কলোনিয়াল লিগ্যাসি ইত্যাদির সরণী বেয়ে পথ চলতে হয়। এডওয়ার্ড সাঈদের ওরিয়েন্টলিজম তত্ত্ব এক্ষেত্রে একটি বড় হাতিয়ার যা দিয়ে প্রাচ্য সম্পর্কে প্রতীচ্যের চেতনার ভেতরকাঠামোতে প্রবেশ করা যায়। অর্থাৎ উত্তর-উপনিবেশিবাদী সাহিত্যতত্ত্ব খোঁড়াখুঁড়ির মধ্যদিয়ে আত্ম-আবিষ্কারের যাত্রা পথটি তৈরি করে দিয়েছে। উপনিবেশিত দেশগুলির সাহিত্য বিশ্লেণের তত্ত্ব হলেও মজার কথা এই যে, তত্ত্বটি এককালের উপনিবেশ-প্রভুদের দেশেই চর্চিত হচ্ছে প্রাতিষ্ঠানিক ভাবেই, ঠিক যেমন পুঁচিবাদী দেশগুলিই মার্কসবাদকে অধিক হারে পরিচর্যা করে থাকে। তবে, এটুকু বলা যায় যে, এশিয়া-আফ্রিকা-লাতিন আমেরিকায় আত্মজাগ্রত লেখক-সমালোচকদের জন্যে এটি সবচেয়ে লাগসই তত্ত্ব হয়ে উঠেছে, উঠছেও তবে, তত্ত্বটি খুববেশি আক্রমণাত্মক, পরিধ্বংসী (Subversive), যার সঙ্গে মিল আছে নারীবাদী সাহিত্যতত্ত্বের। তবে এটি আন্দোলনও বটে, সেই অর্থে গভীর তাৎপর্যবহ যে-অর্থে আমরা লক্ষ করি সাহিত্যতত্ত্বের আন্দোলনই লাতিন আমেরিকার সাহিত্য, ম্যাজিক রিয়েলিজম এবং মার্কেজকে তাৎপর্যবহ করে তুলেছে। উত্তর-উপনিবেশবাদ একঅর্থে সাহিত্য-সমালোচনার চক্ষুদান করেছে।
নারীবাদী সাহিত্যতত্ত্ব যতটা রাজনৈতিকতায় ভর করে তারও বেশি নির্ভরশীল ভাষাকাঠামোতে। পুরুষতান্ত্রিক সভ্যতা-সংস্কৃতির ইতিহাসকে আক্রমণ কিংবা নারী-পুরুষের অসাম্য ও অধস্তন-উর্ধ্বতন অবস্থান নিয়ে তুখোড় সমালোচনা ইত্যাদি হচ্ছে দৃশ্যমান সূত্র। কিন্তু সাহিত্যতত্ত্বটি জেন্ডার প্রশ্নটিকে ভাষার মধ্য্ইে চিরস্থায়ী রূপে আবিষ্কার করে তাকে বিধ্বস্ত করতে বেশি উৎসাহী হয়। বিশেষ্য, বিশেষণ, ক্রিয়া, সর্বনাম-পদের-বাক্যের সর্বত্র সন্ধান করে ওই পুরুষতত্ত্ব ও নিজের অধ্বস্তন অবস্থা, নিজের সত্তা-হারানোর বাস্তবতা এবং তাকে নস্যাৎ করে আত্মসত্তা সন্ধানের গল্পনির্মাণে অগ্রসর হয়। শিল্পসাহিত্যের যে কোনো শাখাকে বিশ্লেষণ করা সম্ভব এই তত্ত্ব দিয়ে, এমনকিক তাত্ত্বিকদের দৃষ্টিকোণকেও, ফ্রয়েড-লাকাঁর মনস্তত্ত্বকে, রেনেসাঁস-আধুনিকতার বিনির্মাণের ইতিহাসে নারীর অনুপস্থিত-সত্তাকে, ইতিহাস রচয়িতাদেরকে, ধর্মবত্তা দার্শনিকবৃন্দকেও। এ-এক সার্বিক subversive discourse. কিন্তু ভুল ব্যাখ্যায় তত্ত্বটিকে ঘোলাটে করে দেয়ার রাজনৈতিকতাও রয়েছে, আবার হিংস্র নারীবাদীদের আক্রমণাত্মক রচনাশৈলীও এই সাহিত্যেতত্ত্বের আবেদন ও তাৎপর্যকে খানিকটা ভ্রষ্ট করেছে বলা যায়। নারী লেখকরাই শুধূ নারীবাদী সাহিত্য রচনাকারী নন, বিখ্যাত পুরুষ সাহিত্যিকদের রচচনাকর্মে অনায়াসে এই তত্ত্বের সারবত্তা ও দৃষ্টিভঙ্গি আবিষ্কার করা সম্ভব, এবং
কাউকে কাউকে নারী সত্তার অংশীদারী রূপেও চিহ্নিত করা যায়। কাউকে বা নারীবিদ্বেষী বলা যায়। সফোক্লিসের অয়দিপৌস কিংবা শেস্কপীয়দের নারীদের যেমন পুনঃপাঠ করে তত্ত্ব, তেমনি আমাদের রবীন্দ্রনাথ-নজরুলের টেক্সটও অন্যপাঠের দাবি রাখে বিশেষ করে যৌন আইডিওলজির প্রশ্নের জবাব খোঁজার লক্ষ্যে। নারী ও পুরুষ নিজেদের এবং পরস্পরকে একটি পুরুষতান্ত্রিক সমাজে কী দৃষ্টিভঙ্গিতে, কী রূপকল্পে দেখে সেটি বুঝে নয়া সম্ভব। এটি যেহেতু মানবজীবনের গভীরতম ও ব্যক্তিগত স্তরে জড়িয়ে থাকে, তাই টেক্সটে একজন নারী বা পুরুষের আচরণ ও প্রত্যক্ষণকে কীভাবে লেখক বর্ণনা বা চিত্রিত করছেন তাও এই তত্ত্বের আওতায় চলে আসে। তবে ওই ‘ব্যক্তিগত’ একান্তই প্রাইভেট হলেও শেষ পর্যন্ত সেটি রাজনৈতিক, নারীবাদী তাত্ত্বিক কেইট মিলেটের Sexual politics (১৯৬৮) গ্রন্থটি এ বিষয়ে আলোকবর্তিকা। নারীবাদে যৌন সম্পর্কের বিষয়টি এ-সূত্রে যেমন মার্কসীয় রাজনৈতিক বীক্ষাযুক্ত তেমনি নারীর শারীরবৃত্তীয় অস্তিত্ব-সংকটের সঙ্গেও সম্পৃক্ত যা তাকে অধ্বস্তনে পরিণত করে, যা নিয়ে ফ্রেঞ্চ ফেমিনিষ্টরা দ্রোহী হয়েছেন। সত্তরের দশক-পরবর্তী সময়ের এইসব সাহিত্য-সমালোচনাতত্ত্ব নান্দনিকতার অর্থই পাল্টে দিয়ে পাঠের ধারায় একইসঙ্গে বহু সম্ভাবনা ও সংকটের জন্ম দিয়েছে। নিছক রসানভূমি, নান্দনিক সৌন্দর্য, শিল্পের বিষয় ও রূপের সার্থকতা/ব্যর্থতা ইত্যাদি বিচারের দৃষ্টিকোণ নিয়ে সাহিত্য সীমামাংসা শেষ হয় না, দাবি রয়ে যায় আরো বহু কোণ, স্তর, ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ার নানা ভাজ কুলে-কুলে দেখার জন্যে। উপরিউক্ত যে কোনো তত্ত্ব দিয়ে বা সব কয়টি দিয়েও কোনো একটি রচনাকে বর্ণনা করা সম্ভব। এটাই সমালোচনার অসীমতা বা বহুত্ব। কিন্তু সংকট হচ্ছে, আমরা যেন থিয়োরিলব্ধ সাহিত্যকে আঁকড়ে ধরছি, সাহিত্যলব্ধ থিয়োরি বুঝি বা কিছুটা পিছু হটে যাচ্ছে। এই সংকট সম্পর্কে পোস্টমর্ডানিজমের প্রবক্তা জাঁ ফ্যাঁসোয়া লিওতার সতর্ক করেছিলেন তাঁর প্রভাবশালী গ্রন্থ The postmodern condition (১৯৭৯)-এ। ড্যানিয়েল বেলও তাঁর The coming of post-industrial Society (১৯৭৩) গ্রন্থে সামাজিক-অর্থনৈতিক প্ল্যাটফর্মের ওপর তত্ত্বের ভিত্তি দাঁড় করানোর প্রয়াস করেছিলেন। ফলে মনে হতেই পারে বহু বিতর্কিত পোস্টমর্ডানিজম সাহিত্যতত্ত্ব হিসেবে জন্ম নেয়নি। মানব-অভিজ্ঞতার অর্থসন্ধান-উৎসার থেকেই ইতিহাস ক্রমবর্ধমান গতির বিন্যাস হয়ে ওঠে। শিল্পসাহিত্য এই বিন্যাসের সঙ্গেই বহুরূপে মিথস্ক্রিয়া ঘটায়। এ সূত্রটি মনে রেখে বুঝে নেয়া যেতে পারে সাংগঠনিক ও উত্তর-সাংগঠনিক সাহিত্যতত্ত্ব ফরাসি রলাঁ বার্তের চিহ্নতত্ত্ব, দেরিদার অবিনির্মাণবাদ (Deconstruction) ইত্যাদি। প্রসঙ্গত, বলা যায় যে এসব তত্ত্ব মূলতই ভাষাভিত্তিক, ভাষাকে কীভাবে কাজে লাগানো যায় অন্তহীন সত্য ও বাস্তবকে উদ্ভাবনের জন্যে তা নিয়ে ব্যতিব্যস্ত। এবং সমালোচকের কর্তব্য হল সত্যানুসন্ধানের পুরানো পথ ছেড়ে ভাষানির্মিত সত্য ও বাস্তবতাকে উদ্ভাবন-প্রক্রিয়াবলির মধ্যে পর্যবেক্ষণ করা। প্রশ্ন ওঠে, কেন এত তত্ত্বের উদ্ভব ঘটেছে বিশশতকের শেষার্ধে?
সাত
সাহিত্বতাত্ত্বিক টেরি ঈগলটনের মতে, আশাবাদের রাজনৈতিক ম্যাটান্যারেটিভ ধারক বামপন্থীদের পরাজয়ের প্রেক্ষাপটে এতবেশি তত্ত্বের জন্ম হয়েছে। পুঁজিবাদের ভবিষ্যৎহীনতার শঙ্কাও আরেকটি কারণ। তবে বিজ্ঞান-প্রযুক্তির অতিবিকাশ আর জ্ঞানশাখার বহুবিধ উৎসারণ ভাষাকে প্লাবিত করে নিত্যনব তত্ত্ব-তথ্যের পশরা উৎপাদন করে যাচ্ছে। যদিও ডি. ডব্লিউ. ফুকোয়ামা তাঁর হার্ভাড বক্তৃতায় (১৯৮৩) বলেন যে বিশেষভাবে পোস্টমডার্নিজম কোড একটি নির্দিষ্ট দৃষ্টিভঙ্গি ও পন্থার সঙ্গে যুক্ত যা প্রতীচ্যে দৃশ্যমান, কিছু অংশে লাতিন আমেরিকায়ও। এর ভৌগোলিক-সামাজিক সীমাবদ্ধতা রয়েছে।
রলাঁ বার্তের Writing Degree zero (১৯৫৩) রচনায় ব্যক্ত হয়েছিল ভাষা ও চিহ্নের তাৎপর্য অন্তত লেখালেখির ক্ষেত্রে। তিনি ভাষা ও লেখকের শৈলীকে একটি শব্দের মাধ্যমরূপে ব্যাখ্যা করেন সেটি হল লিখন (writing) লেখকের কাছে যে ভাষা দাঁড়িয়ে আছে তা একটি যুগের সমস্ত লেখকের জন্যেই ‘বিভিন্ন সর্বজনীন বিধান ও অভ্যাসের সমবায়’। এটি লেখকের সীমা আবার তাঁর দিগন্তও। তাঁর জৈবিক বা শারীরিক অভ্যাস, হিয়ুম-লীর ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া এবং অতীতকাল থেকে জন্ম নেয়া কিছু চিত্র, বাগ্ভঙ্গি আর বিশিষ্ট শব্দসম্ভার শিল্পের স্বায়ংক্রিয়তায় পরিণত হয়, তাঁর শৈলী গড়ে তোলে। সময় ও ব্যক্তির জৈব-আস্তিত্বিক সীমা তেকে স্বাভাবিকভাবেই ভাষা-শৈলী গড়ে তোলে। সময় ও ব্যক্তির জৈব-আস্তিত্বিক সীমা থেকে স্বাভাবিকভাবেই ভাষা-শৈলী গড়ে তোলে। সময় ও ব্যক্তির জৈব-আস্তিত্বিক সীমা থেকে স্বাভাবিকভাবেই ভাষা-শৈলী গড়ে তোলে। সময় ও ব্যক্তির জৈব-আস্তিত্বিক সীমা তেকে স্বাভাবিকভাবেই ভাষা-শৈলী লেখকের সামগ্রী হয়ে ওঠে, তাই লিখনক্রিয়াকে বলা চলে একদরণের কার্যকারিতা (function)। এই লিখনকে বার্ত সনাক্ত করেন সৃষ্টিকর্ম ও সমাজের মধ্যে সম্পর্কসেতু, অতএব তা একটি প্রকরণ যা মানবিক, মোটই দৈবিক কিছু নয়। এখানেই আধুনিকবাদের সঙ্গে উত্তর-আধুনিকতার বিরোধ তৈরি হয়। উত্তর-আধুনিকতায় রচনা হচ্ছে বহু লিখনের সমাবেশ দিয়ে বিনির্মিত যা আসতে পারে যেকোনো কাল, কৃষ্টি, সমাজ থেকে। এবং এই সমাবেশ ঘটতে পারে ভাববিনিময়ের লক্ষ্যে, শ্লেষ বিদ্রুপের জন্যে, কখনোবা বিরোধ সৃষ্টির উদ্দেশ্যে, অথবা শুধুই ভাষার ধ্বনিমর্মকে ছোঁয়ার জন্যে। আধুনিক কবিতা স্টাইল ও কবিব্যক্তিকে স্বাতন্ত্র্যসূত্র দিয়ে ওই ভাষিক সংযোগ-বিয়োজক সূত্রগুলিকে ধ্বংস করেছিল এবং কবির বাচনকে দিয়েছিল মুখ্য স্থান ও শব্দের স্থিতিতে দৃঢ়বদ্ধ। তাই এখানে লিখন ছিল না বলেই মনে করেন বার্ত। ভাষার ক্রিয়াশীলতা বিনষ্ট করে এই সাহিত্য শুধু শব্দভিত্তিকে শিষ্টতা দিয়েছিল। যেমন, আধুনিক সাহিত্যকেরাও মিথ ব্যবহার করেছিলেন অলংকার বা প্রসঙ্গ সূত্রে, বা বক্তব্যের মুখশ্রী, প্রতীক তৈরিতে। উত্তর আধুনিকদের কাছে মিথ হচ্ছে নিজেই এটি ভাষা, তা আকরণের বা কাঠামোর গভীরে মিশে থাকে। ক্লদ লোভ স্ট্রস তো পুরাণভাষার মধ্যে বিশ্বজনীন চিন্তার প্যাটার্নই আবিষ্কার করে তাঁর প্রভাবশালী সাংগঠনিক নৃতত্ত্ব গড়ে তোলেন।
কাজেই বার্তের লিখনক্রিয়ার মধ্যে লেখকের কণ্ঠস্বর, লেখার উৎস নিয়ে কোনো বাকবিতণ্ডা থাকে না, লেখকের মৃত্যু গটে এবং লেখা একটি নিরপেক্ষ বিকল্প স্পেস হয়ে ওঠে যেখানে অর্থ পিছলে যায়, শুধু জেগে থাকে লিখনক্রিয়া। ঔপন্যাসিক অমিয়ভূষণ মজুমদার এ-অর্থেই রচনা করেন ‘লিখিনে কী ঘটে’ (১৯৭৯) লেখাটি। অবিনির্মাণবাদী–
of Grammatology– রচয়িতা জাঁক দেরিদা এই ভাষাকাঠামোকে আরো বিস্তৃত করেন এবং যে কোনো অধিবিদ্যক ধারণা যা লেখায়-ভাষায় আগেই উপস্থিত থাকে তার বিনাশ ঘোষণা করেন। যেকোনো জ্ঞানতত্ত্ব বা শাস্ত্র চর্চার ক্ষেত্রে যেসব ধারণা এতকাল প্রাধান্য পেয়ে আসছে, তার মধ্যে অর্থের উপস্থিতি আছে বলে ভাবা হয়েছে, দেরিদা সেসব অর্থের প্রাধান্য তো দূরের কথা অস্তিত্বকেই অস্বীকার করেন। তাঁর অবিনির্মাণ তত্ত্বটির উদ্ভব ষাটের দশকে, চিহ্নের ধারণাকে অবলম্বন করে যে চিহ্নপদ্ধতি দিয়ে সংস্কৃতিকে পর্যবেক্ষণ করে অর্থ উদ্ধার করা যায় অর্থাৎ রলাঁ বার্তের Semiology তত্ত্ব যার ভিত্তি ছিল সোসুরের দ্যোতক ও দ্যোতনা তথা চিহ্ন ও চিহ্নায়ক। চিহ্ন বস্তুকে নির্দেশ করে না, মনের কোনো ধারণাকে নির্দেশ করে। এবং ধারণাটি সর্বদাই পাথর্ক্যরে দ্বারা বোধ্য, যেমন শাদা রঙ বোঝা যায় কালোর পাথর্ক্য।ে এভাবে সংস্কৃতিকেও বোঝা যাবে চিহ্নের মাধ্যমে। তার অর্থ উদ্ধার করা সম্ভব হবে। তবে, যে কোনো রচনাকে ব্যাখ্যা করার সূত্রগুলোকে কাঠামোবদ্ধ করা হয় বলে এই তত্ত্বের সম্প্রসারণ ঘটে উত্তর-কাঠামোবাদে এবং অবিনির্মাণ তত্ত্বে। টেক্সটকে দেখা হতে থাকে স্তির অর্থের মধ্যে, কাঠামোবদ্ধ রূপে নয় রূপান্তরশীল সত্তা হিসেবে গতিমান অর্থে। ‘হংস’ দ্যোতকটি একটি পাখিকে নির্দেশ করে না, করে বিশেষ পাখি সম্পর্কে আমাদের ধারণা কে যা অন্র সদৃশ শব্দের সঙ্গে পার্থক্যসূচক। এই দ্যোতকটি জীবনানন্দের ‘বুনো হাঁস’ কবিতাটিকে দ্যোতিত করতে পারে। সেটি আবার দ্যোতক হয়ে রামকৃষ্ণ পরমহংসের দ্যোতনাও সৃষ্টি করতে পারে, তা দিয়ে আমরা পেতে পারি একটি সম্প্রদায়ের ধর্মীয় সংস্কৃতি, তা থেকে যেতে পারি আত্মার প্রীতক ‘হংস’– এই চিহ্নে, এভাবে অজস্র দ্যোতক- দ্যোতনার রূপান্তরশীল খেলা চলতে পারে। দেরিদার অবিনির্মাণ এই অর্থের/ দ্যোতনার বহু সম্ভাবনাকে স্বীকৃতি দেয়। তবে এরকম নানা অর্থের সন্ধানের পথে কোনোটি আবার স্ববিরোধীও হতে পারে। এই স্ববিরোধীকে আবিষ্কার করার মধ্যদিয়েই টেক্সটে যা লেখা হচ্ছে তা যে শেষ পর্যন্ত বিরোধী কোনো দ্যোতনাই তুলে ধরছে তা ব্যাখ্যা করা সম্ভব হয়। আমাদের চিন্তা সর্বক্ষণ পরিবর্তিত হচ্ছে, দ্যোতকগুলি একটি থেকে কয়েকটিতে চলে যাচ্ছে, ফলে স্থিতি তৈরি করতে গিয়ে দেখা যায় যে ভাষাটাই অস্থিতিশীলই হয়ে উঠছে। এভাবে দ্যোতক বারংবার বদল হলেও তার প্রতিটি পদচ্ছাপ বা চিহ্ন রেখে যায় বলে আমরা যেকোনো রচনায় ওইসব চিহ্ন থেকে অনেক অর্থ পাব। এ এক আশঙ্কাজনক অবস্থা, হতাশাগ্রস্ত তত্ত্বও বটে। তাহলে, আমরা কীভাবে স্থির অর্থে বা সত্যে পৌঁছাব? দেরিদার উত্তরর হচ্ছে চূড়ান্ত অর্থ বলে কিছু পাওয়ার নেই, এতকাল মানবসমাজ যেসব অর্থকেন্দ্র তৈরি করে স্থিতি লাভের চেতনা গড়েছে সেটি মানুষকে ‘কেন্দ্র’-কেন্দ্রিক একটা ধারণায় আবদ্ধ করে রেখেছে। আমরা অভ্যাসবশে কেন্দ্র খুঁজি অর্থকেন্দ্র, ঈশ্বরকেন্দ্র, ক্ষমতাকেন্দ্র ইত্যাদি। এই কেন্দ্রই ভেঙে দিতে চাইছেন জাঁক দেরিদা–এটাই তাঁর বিনির্মাণ পদ্ধতি। অধিবিদ্যার স্থির পরম সত্তা-কেন্দ্র থেকেই এতদিন সভ্যতার ইতিহাস বয়ান করা হয়েছে। এই ইতিহাসের বিপরীতে গিয়ে দেরিদা পরমসত্তার কেন্দ্র-উৎসারিত অর্থ ভেঙে আরো বহু অর্থের সম্ভাবনার যে পদ্ধতি বাৎলান তার অন্তর্নিহিত তাৎপর্যটা কী?
বিনির্মাণবাদ লিখনক্রিয়ায় কথকের উচ্চারণ চাপা পড়ে যায় বলে মনে করে। লিখন নিকৃষ্ট, কথন উৎকৃষ্ট। কাজেই কথন/লিখন– এই ক্রম হওয়া উচিত। কথনের মধ্যে ব্যক্তি যতটা উপস্থিত থাকে, লিখনের মধ্যে ততটাই অনুপস্থিত থাকে। কখক উপস্থিত না থাকলেই লিখন কাজ করে, তখন এই লিখনে অনুপস্থিত কথনকে আবিষ্কার করাই হচ্ছে অর্থকেন্দ্রকে বুঝে নেয়া, কথার মধ্যেই অর্থকেন্দ্রের প্রাধান্য থাকে। এসব উপপাত্তের মূল ব্যাপার হচ্ছে এই বাবনা যে, ভাষাই মানুষকে সত্তাবান করে। এবং ওইসব দ্যোতক-দ্যোতনা আর যুগ্মবৈপরীত্য (শাদা/কালো, ভালো/মন্দ ইত্যাদি) স্ব-স্ব স্থান বদল করতে পারে বলে মূল্যবোধ-ধারণা বিশ্বাস ইত্যাদিরও দিক বদল সম্ভব হয়। স্থির অর্থ বা পরমকে বিচ্যুত করে কেন্দ্রের বাইরে এনে তাকে ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ করা যায়, যাচাই করা যায়। এইভাবেই আমরা লিখনকে কথনের আগে নিয়ে আসতে পারি কথনকে কেন্দ্রচ্যুত করে এবং বারংবার লিখনকে পাঠ, পুনর্পাঠ করে নতুন নতুন অর্থ পেতে পারি, স্ববিরোধকে চিহ্নিত করে পরম, চিরন্তন, মহাকাল ইত্যাদি প্যারাডাইমকে বদলে দিতে পারি। বস্তুত, প্রতীচ্যের সভ্যতাকেন্দ্রই বাকি বিশ্বের অভিমুখ গড়ে দিয়েছে এমনভাবে যে সভ্যতা মানেই প্রতীচ্যের সভ্যতা, আধুনিক হওয়াই সভ্য হওয়া। কিন্তু সভ্যতার আরো বিকল্প, আরো চম
কারিত্ব, তাৎপর্যময়তা রয়েছে, সেটি এককেন্দ্রিকাতায় চাপা পড়ে আছে। দেরিদার চিন্তা প্রকল্প দিয়ে আমরা এই কেন্দ্র/প্রান্তের স্থান বদলের ঘটনা ঘটাতে পারি,
সাহিত্বতাত্ত্বিক টেরি ঈগলটনের মতে, আশাবাদের রাজনৈতিক ম্যাটান্যারেটিভ ধারক বামপন্থীদের পরাজয়ের প্রেক্ষাপটে এতবেশি তত্ত্বের জন্ম হয়েছে। পুঁজিবাদের ভবিষ্যৎহীনতার শঙ্কাও আরেকটি কারণ। তবে বিজ্ঞান-প্রযুক্তির অতিবিকাশ আর জ্ঞানশাখার বহুবিধ উৎসারণ ভাষাকে প্লাবিত করে নিত্যনব তত্ত্ব-তথ্যের পশরা উৎপাদন করে যাচ্ছে। যদিও ডি. ডব্লিউ. ফুকোয়ামা তাঁর হার্ভাড বক্তৃতায় (১৯৮৩) বলেন যে বিশেষভাবে পোস্টমডার্নিজম কোড একটি নির্দিষ্ট দৃষ্টিভঙ্গি ও পন্থার সঙ্গে যুক্ত যা প্রতীচ্যে দৃশ্যমান, কিছু অংশে লাতিন আমেরিকায়ও। এর ভৌগোলিক-সামাজিক সীমাবদ্ধতা রয়েছে।
রলাঁ বার্তের Writing Degree zero (১৯৫৩) রচনায় ব্যক্ত হয়েছিল ভাষা ও চিহ্নের তাৎপর্য অন্তত লেখালেখির ক্ষেত্রে। তিনি ভাষা ও লেখকের শৈলীকে একটি শব্দের মাধ্যমরূপে ব্যাখ্যা করেন সেটি হল লিখন (writing) লেখকের কাছে যে ভাষা দাঁড়িয়ে আছে তা একটি যুগের সমস্ত লেখকের জন্যেই ‘বিভিন্ন সর্বজনীন বিধান ও অভ্যাসের সমবায়’। এটি লেখকের সীমা আবার তাঁর দিগন্তও। তাঁর জৈবিক বা শারীরিক অভ্যাস, হিয়ুম-লীর ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া এবং অতীতকাল থেকে জন্ম নেয়া কিছু চিত্র, বাগ্ভঙ্গি আর বিশিষ্ট শব্দসম্ভার শিল্পের স্বায়ংক্রিয়তায় পরিণত হয়, তাঁর শৈলী গড়ে তোলে। সময় ও ব্যক্তির জৈব-আস্তিত্বিক সীমা তেকে স্বাভাবিকভাবেই ভাষা-শৈলী গড়ে তোলে। সময় ও ব্যক্তির জৈব-আস্তিত্বিক সীমা থেকে স্বাভাবিকভাবেই ভাষা-শৈলী গড়ে তোলে। সময় ও ব্যক্তির জৈব-আস্তিত্বিক সীমা থেকে স্বাভাবিকভাবেই ভাষা-শৈলী গড়ে তোলে। সময় ও ব্যক্তির জৈব-আস্তিত্বিক সীমা তেকে স্বাভাবিকভাবেই ভাষা-শৈলী লেখকের সামগ্রী হয়ে ওঠে, তাই লিখনক্রিয়াকে বলা চলে একদরণের কার্যকারিতা (function)। এই লিখনকে বার্ত সনাক্ত করেন সৃষ্টিকর্ম ও সমাজের মধ্যে সম্পর্কসেতু, অতএব তা একটি প্রকরণ যা মানবিক, মোটই দৈবিক কিছু নয়। এখানেই আধুনিকবাদের সঙ্গে উত্তর-আধুনিকতার বিরোধ তৈরি হয়। উত্তর-আধুনিকতায় রচনা হচ্ছে বহু লিখনের সমাবেশ দিয়ে বিনির্মিত যা আসতে পারে যেকোনো কাল, কৃষ্টি, সমাজ থেকে। এবং এই সমাবেশ ঘটতে পারে ভাববিনিময়ের লক্ষ্যে, শ্লেষ বিদ্রুপের জন্যে, কখনোবা বিরোধ সৃষ্টির উদ্দেশ্যে, অথবা শুধুই ভাষার ধ্বনিমর্মকে ছোঁয়ার জন্যে। আধুনিক কবিতা স্টাইল ও কবিব্যক্তিকে স্বাতন্ত্র্যসূত্র দিয়ে ওই ভাষিক সংযোগ-বিয়োজক সূত্রগুলিকে ধ্বংস করেছিল এবং কবির বাচনকে দিয়েছিল মুখ্য স্থান ও শব্দের স্থিতিতে দৃঢ়বদ্ধ। তাই এখানে লিখন ছিল না বলেই মনে করেন বার্ত। ভাষার ক্রিয়াশীলতা বিনষ্ট করে এই সাহিত্য শুধু শব্দভিত্তিকে শিষ্টতা দিয়েছিল। যেমন, আধুনিক সাহিত্যকেরাও মিথ ব্যবহার করেছিলেন অলংকার বা প্রসঙ্গ সূত্রে, বা বক্তব্যের মুখশ্রী, প্রতীক তৈরিতে। উত্তর আধুনিকদের কাছে মিথ হচ্ছে নিজেই এটি ভাষা, তা আকরণের বা কাঠামোর গভীরে মিশে থাকে। ক্লদ লোভ স্ট্রস তো পুরাণভাষার মধ্যে বিশ্বজনীন চিন্তার প্যাটার্নই আবিষ্কার করে তাঁর প্রভাবশালী সাংগঠনিক নৃতত্ত্ব গড়ে তোলেন।
কাজেই বার্তের লিখনক্রিয়ার মধ্যে লেখকের কণ্ঠস্বর, লেখার উৎস নিয়ে কোনো বাকবিতণ্ডা থাকে না, লেখকের মৃত্যু গটে এবং লেখা একটি নিরপেক্ষ বিকল্প স্পেস হয়ে ওঠে যেখানে অর্থ পিছলে যায়, শুধু জেগে থাকে লিখনক্রিয়া। ঔপন্যাসিক অমিয়ভূষণ মজুমদার এ-অর্থেই রচনা করেন ‘লিখিনে কী ঘটে’ (১৯৭৯) লেখাটি। অবিনির্মাণবাদী–
of Grammatology– রচয়িতা জাঁক দেরিদা এই ভাষাকাঠামোকে আরো বিস্তৃত করেন এবং যে কোনো অধিবিদ্যক ধারণা যা লেখায়-ভাষায় আগেই উপস্থিত থাকে তার বিনাশ ঘোষণা করেন। যেকোনো জ্ঞানতত্ত্ব বা শাস্ত্র চর্চার ক্ষেত্রে যেসব ধারণা এতকাল প্রাধান্য পেয়ে আসছে, তার মধ্যে অর্থের উপস্থিতি আছে বলে ভাবা হয়েছে, দেরিদা সেসব অর্থের প্রাধান্য তো দূরের কথা অস্তিত্বকেই অস্বীকার করেন। তাঁর অবিনির্মাণ তত্ত্বটির উদ্ভব ষাটের দশকে, চিহ্নের ধারণাকে অবলম্বন করে যে চিহ্নপদ্ধতি দিয়ে সংস্কৃতিকে পর্যবেক্ষণ করে অর্থ উদ্ধার করা যায় অর্থাৎ রলাঁ বার্তের Semiology তত্ত্ব যার ভিত্তি ছিল সোসুরের দ্যোতক ও দ্যোতনা তথা চিহ্ন ও চিহ্নায়ক। চিহ্ন বস্তুকে নির্দেশ করে না, মনের কোনো ধারণাকে নির্দেশ করে। এবং ধারণাটি সর্বদাই পাথর্ক্যরে দ্বারা বোধ্য, যেমন শাদা রঙ বোঝা যায় কালোর পাথর্ক্য।ে এভাবে সংস্কৃতিকেও বোঝা যাবে চিহ্নের মাধ্যমে। তার অর্থ উদ্ধার করা সম্ভব হবে। তবে, যে কোনো রচনাকে ব্যাখ্যা করার সূত্রগুলোকে কাঠামোবদ্ধ করা হয় বলে এই তত্ত্বের সম্প্রসারণ ঘটে উত্তর-কাঠামোবাদে এবং অবিনির্মাণ তত্ত্বে। টেক্সটকে দেখা হতে থাকে স্তির অর্থের মধ্যে, কাঠামোবদ্ধ রূপে নয় রূপান্তরশীল সত্তা হিসেবে গতিমান অর্থে। ‘হংস’ দ্যোতকটি একটি পাখিকে নির্দেশ করে না, করে বিশেষ পাখি সম্পর্কে আমাদের ধারণা কে যা অন্র সদৃশ শব্দের সঙ্গে পার্থক্যসূচক। এই দ্যোতকটি জীবনানন্দের ‘বুনো হাঁস’ কবিতাটিকে দ্যোতিত করতে পারে। সেটি আবার দ্যোতক হয়ে রামকৃষ্ণ পরমহংসের দ্যোতনাও সৃষ্টি করতে পারে, তা দিয়ে আমরা পেতে পারি একটি সম্প্রদায়ের ধর্মীয় সংস্কৃতি, তা থেকে যেতে পারি আত্মার প্রীতক ‘হংস’– এই চিহ্নে, এভাবে অজস্র দ্যোতক- দ্যোতনার রূপান্তরশীল খেলা চলতে পারে। দেরিদার অবিনির্মাণ এই অর্থের/ দ্যোতনার বহু সম্ভাবনাকে স্বীকৃতি দেয়। তবে এরকম নানা অর্থের সন্ধানের পথে কোনোটি আবার স্ববিরোধীও হতে পারে। এই স্ববিরোধীকে আবিষ্কার করার মধ্যদিয়েই টেক্সটে যা লেখা হচ্ছে তা যে শেষ পর্যন্ত বিরোধী কোনো দ্যোতনাই তুলে ধরছে তা ব্যাখ্যা করা সম্ভব হয়। আমাদের চিন্তা সর্বক্ষণ পরিবর্তিত হচ্ছে, দ্যোতকগুলি একটি থেকে কয়েকটিতে চলে যাচ্ছে, ফলে স্থিতি তৈরি করতে গিয়ে দেখা যায় যে ভাষাটাই অস্থিতিশীলই হয়ে উঠছে। এভাবে দ্যোতক বারংবার বদল হলেও তার প্রতিটি পদচ্ছাপ বা চিহ্ন রেখে যায় বলে আমরা যেকোনো রচনায় ওইসব চিহ্ন থেকে অনেক অর্থ পাব। এ এক আশঙ্কাজনক অবস্থা, হতাশাগ্রস্ত তত্ত্বও বটে। তাহলে, আমরা কীভাবে স্থির অর্থে বা সত্যে পৌঁছাব? দেরিদার উত্তরর হচ্ছে চূড়ান্ত অর্থ বলে কিছু পাওয়ার নেই, এতকাল মানবসমাজ যেসব অর্থকেন্দ্র তৈরি করে স্থিতি লাভের চেতনা গড়েছে সেটি মানুষকে ‘কেন্দ্র’-কেন্দ্রিক একটা ধারণায় আবদ্ধ করে রেখেছে। আমরা অভ্যাসবশে কেন্দ্র খুঁজি অর্থকেন্দ্র, ঈশ্বরকেন্দ্র, ক্ষমতাকেন্দ্র ইত্যাদি। এই কেন্দ্রই ভেঙে দিতে চাইছেন জাঁক দেরিদা–এটাই তাঁর বিনির্মাণ পদ্ধতি। অধিবিদ্যার স্থির পরম সত্তা-কেন্দ্র থেকেই এতদিন সভ্যতার ইতিহাস বয়ান করা হয়েছে। এই ইতিহাসের বিপরীতে গিয়ে দেরিদা পরমসত্তার কেন্দ্র-উৎসারিত অর্থ ভেঙে আরো বহু অর্থের সম্ভাবনার যে পদ্ধতি বাৎলান তার অন্তর্নিহিত তাৎপর্যটা কী?
বিনির্মাণবাদ লিখনক্রিয়ায় কথকের উচ্চারণ চাপা পড়ে যায় বলে মনে করে। লিখন নিকৃষ্ট, কথন উৎকৃষ্ট। কাজেই কথন/লিখন– এই ক্রম হওয়া উচিত। কথনের মধ্যে ব্যক্তি যতটা উপস্থিত থাকে, লিখনের মধ্যে ততটাই অনুপস্থিত থাকে। কখক উপস্থিত না থাকলেই লিখন কাজ করে, তখন এই লিখনে অনুপস্থিত কথনকে আবিষ্কার করাই হচ্ছে অর্থকেন্দ্রকে বুঝে নেয়া, কথার মধ্যেই অর্থকেন্দ্রের প্রাধান্য থাকে। এসব উপপাত্তের মূল ব্যাপার হচ্ছে এই বাবনা যে, ভাষাই মানুষকে সত্তাবান করে। এবং ওইসব দ্যোতক-দ্যোতনা আর যুগ্মবৈপরীত্য (শাদা/কালো, ভালো/মন্দ ইত্যাদি) স্ব-স্ব স্থান বদল করতে পারে বলে মূল্যবোধ-ধারণা বিশ্বাস ইত্যাদিরও দিক বদল সম্ভব হয়। স্থির অর্থ বা পরমকে বিচ্যুত করে কেন্দ্রের বাইরে এনে তাকে ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ করা যায়, যাচাই করা যায়। এইভাবেই আমরা লিখনকে কথনের আগে নিয়ে আসতে পারি কথনকে কেন্দ্রচ্যুত করে এবং বারংবার লিখনকে পাঠ, পুনর্পাঠ করে নতুন নতুন অর্থ পেতে পারি, স্ববিরোধকে চিহ্নিত করে পরম, চিরন্তন, মহাকাল ইত্যাদি প্যারাডাইমকে বদলে দিতে পারি। বস্তুত, প্রতীচ্যের সভ্যতাকেন্দ্রই বাকি বিশ্বের অভিমুখ গড়ে দিয়েছে এমনভাবে যে সভ্যতা মানেই প্রতীচ্যের সভ্যতা, আধুনিক হওয়াই সভ্য হওয়া। কিন্তু সভ্যতার আরো বিকল্প, আরো চম
কারিত্ব, তাৎপর্যময়তা রয়েছে, সেটি এককেন্দ্রিকাতায় চাপা পড়ে আছে। দেরিদার চিন্তা প্রকল্প দিয়ে আমরা এই কেন্দ্র/প্রান্তের স্থান বদলের ঘটনা ঘটাতে পারি,
উধ্বতন/অধ্বস্তনের বৈপরীত্য ধ্বংসের জন্যে তাদের অবস্থা পান্টে দিতে পারি। এ সবই শুধু সম্ভব টেক্সট বিশ্লেষণের পাঠের তথা ভাষার জগতে। দেরিদা অর্থনৈতিক বা রাজনৈতিক বিপ্লবের কথা উত্থাপন করেন না, তাঁর লক্ষ্য ভাষায় পরম অর্থের, লেখকসত্তার কেন্দ্রস্থান দখলের তথা ক্ষমতায়নের বিন্যাসটি এলামেলো করে দেয়া। যা কখনো কখনো স্ববিরোধী সংঘর্ষশীল হলেও অনেকসময়ই সমঝোতার ও সহযোগিতামূলক যেন ডিবেটের মুক্তমঞ্চ। সমাজরে মূল বৈশিষ্ট্য যেন সহমত ঐক্যবদ্ধতা ও মৈত্রীবোধ নয়, বিতর্ক অথবা আপসই মুখ্য।
উপরিউক্ত আলোচনার ভিত্তিতে এটাই বলা যায় যে উত্তর আধুনিকতার সহগামী এসব তত্ত্ববাদ-পদ্ধতি সমালোচনা-সাহিত্যে যেসব তাৎপর্যসূচক ভিন্নতা এনেছে তা হল, বহু ভাষিকতা, চিহ্ন-সংশ্লেষণ, সামাজিক সাংস্কৃতিক বয়ান, কথনস্পন্দন, বহুরুপত্ব, আন্তর্বয়ান ইত্যাদি সাহিত্য সমালোচনামূলক রীতিপদ্ধতির সূত্রাবলি। বাংলা সাহিত্যে বিশেষত পশ্চিমবঙ্গে উত্তর আধুনিক সাহিত্য-আন্দোলন (যদিও প্রতীচ্যে এটা কোনো সাহিত্য আন্দোলন নয়) নিয়ে যে ঘরানা তৈরি হয়েছে-হচ্ছে তা কিন্তু প্রতীচ্যের আদলে নয়। একটু আগে উদ্ধৃত সূত্রগুলি কিন্তু বাংলা সাহিত্যের উত্তর আধুনিক লেখালেখিতেই দৃশ্যমান, ব্যবহৃত ও প্রচারিত। ঢাকাকেন্দ্রিক সাহিত্যচর্চায় বিভিন্ন লিটল ম্যাগাজিনের মধ্যদিয়ে বিকল্পিত, তর্কিত, বিবর্তিত হয়ে উত্তর আধুনিকতা এখন মুদ্রিত গ্রন্থের রূপ ধারণ করেছে। এবং বাংলা সাহিত্যে নিজস্ব উত্তর আধুনিকতার প্রতিষ্ঠা দিয়েছে টেক্সটে ও তার সমালোচনা-ধারায়। আর আমাদের এই বিপুল জনবসতির রাজধানী ঢাকা শহর যে প্রতীচ্য আধুনিকতার চারিত্র্য অর্জন না করেই উত্তর আধুনিক হয়ে উঠছে তার চিহ্ন ঢাকার রাস্তার যানবাহন, মানুষের সঙ্গে সম্পর্কের রূপ বদল, সর্বোপরি রাজনীতি সংস্কৃতি ও ভাষার কথন ও লিখন পদ্ধতিতে, সৃষ্টিশীল রচনাকর্মে কমবেশি যে দৃশ্যমান এ কথা মেনে নিতেই হবে।
আট
এককেন্দ্রিক বিশ্বব্যবস্থাধীন ভাবুকেরা বিশ্বসংস্কৃতি বা বিশ্বজাতিকতার ধারণা ইতিউতি উচ্চারণ করলেও সাহিত্যের বেলায় বিশ্বসমালোচনা তত্ত্ব বলে কোনো চিন্তা করেননি। আজকের কর্ফোরেট বাণিজ্যব্যবস্থাধীন বিশ্বায়ন কথাটিও এরকম কিছু বহন করে না। কারণ বিশ্বায়ন তো এককেন্দ্রিক ক্ষমতায়ন ও সংস্কৃতির আধিপত্য কায়েমের অর্থনৈতিক প্রোগ্রাম মাত্র যা জনগণের রাষ্ট্রের হাত থেকে চলে গেছে মুষ্টিমেয় ধনিক শ্রেণীর হাতে। এর প্রতিফল স্বরূপ আধিপত্যবাদী দেশের শিল্প সাহিত্য-সমালোচনা যাকে বলা হয় ইউরো-মার্কিন, প্রাচ্য ভূখণ্ডে দীর্ঘকাল ধরেই রপ্তানি করা হচ্ছিল। বিশ্ববাণিজ্যের ইতিহাসে উপনিবেশ, সা¤্রাজ্যবাদ, জাতীয়তাবাদের প্যারাডাইম থেকে উছলে পড়া সমালোচনা সাহিত্যতত্ত্বেরও একটা রপ্তানি ব্যবস্থা গড়ে উঠেছে। বিশ শতক থেকেই এর শুরু ও প্রতিষ্ঠালাভ যে সমাজকাঠামোতে এইসব তত্ত্বজ্ঞানের উৎপাদন ও বিস্তার ঘটেছে, সেরকম কাঠামো যে দেশে বা স্থানে নেই সেখানে এর প্রয়োগ পরিচর্যা কতখানি যৌক্তিক? ওহ, যৌক্তিকতার প্রশ্নতো তোলাই যাবে না, কারণ যুক্তিবাদ অধুনাতত্ত্বে পরিত্যক্ত। তবে, বলতে হবে বিশ্বজাতিকতা ও মানবপ্রজাতির মানসবৈভবের (যদিও তা ভাষাময়, তাও আবার ইংরেজি ভাষা।) অংশীদার রূপে ওইসব তত্ত্বজ্ঞান নিয়ে কাজ করবার দাবি আমরা অবশ্যই করতে পারি। তবে তত্ত্বানুসরণ যেন সর্বগ্রাসী হয়ে আমাদের চিহ্নহীন না করে ফেলে, সে বিষয়ে স্বচ্ছ থাকা প্রয়োজন। আমাদের সাহিত্য-সংস্কৃতির প্রয়োজন যদি তাতে মেটে, তাহলে অবশ্যই সেসব থেকে আবশ্যকীয় উপাদান পদ্ধতি সূত্র গ্রহণ করতে হবে।
এককেন্দ্রিক বিশ্বব্যবস্থাধীন ভাবুকেরা বিশ্বসংস্কৃতি বা বিশ্বজাতিকতার ধারণা ইতিউতি উচ্চারণ করলেও সাহিত্যের বেলায় বিশ্বসমালোচনা তত্ত্ব বলে কোনো চিন্তা করেননি। আজকের কর্ফোরেট বাণিজ্যব্যবস্থাধীন বিশ্বায়ন কথাটিও এরকম কিছু বহন করে না। কারণ বিশ্বায়ন তো এককেন্দ্রিক ক্ষমতায়ন ও সংস্কৃতির আধিপত্য কায়েমের অর্থনৈতিক প্রোগ্রাম মাত্র যা জনগণের রাষ্ট্রের হাত থেকে চলে গেছে মুষ্টিমেয় ধনিক শ্রেণীর হাতে। এর প্রতিফল স্বরূপ আধিপত্যবাদী দেশের শিল্প সাহিত্য-সমালোচনা যাকে বলা হয় ইউরো-মার্কিন, প্রাচ্য ভূখণ্ডে দীর্ঘকাল ধরেই রপ্তানি করা হচ্ছিল। বিশ্ববাণিজ্যের ইতিহাসে উপনিবেশ, সা¤্রাজ্যবাদ, জাতীয়তাবাদের প্যারাডাইম থেকে উছলে পড়া সমালোচনা সাহিত্যতত্ত্বেরও একটা রপ্তানি ব্যবস্থা গড়ে উঠেছে। বিশ শতক থেকেই এর শুরু ও প্রতিষ্ঠালাভ যে সমাজকাঠামোতে এইসব তত্ত্বজ্ঞানের উৎপাদন ও বিস্তার ঘটেছে, সেরকম কাঠামো যে দেশে বা স্থানে নেই সেখানে এর প্রয়োগ পরিচর্যা কতখানি যৌক্তিক? ওহ, যৌক্তিকতার প্রশ্নতো তোলাই যাবে না, কারণ যুক্তিবাদ অধুনাতত্ত্বে পরিত্যক্ত। তবে, বলতে হবে বিশ্বজাতিকতা ও মানবপ্রজাতির মানসবৈভবের (যদিও তা ভাষাময়, তাও আবার ইংরেজি ভাষা।) অংশীদার রূপে ওইসব তত্ত্বজ্ঞান নিয়ে কাজ করবার দাবি আমরা অবশ্যই করতে পারি। তবে তত্ত্বানুসরণ যেন সর্বগ্রাসী হয়ে আমাদের চিহ্নহীন না করে ফেলে, সে বিষয়ে স্বচ্ছ থাকা প্রয়োজন। আমাদের সাহিত্য-সংস্কৃতির প্রয়োজন যদি তাতে মেটে, তাহলে অবশ্যই সেসব থেকে আবশ্যকীয় উপাদান পদ্ধতি সূত্র গ্রহণ করতে হবে।
যেমন, উত্তর উপনিবেশবাদী সাহিত্যতত্ত্ব দিয়ে আমরা তদন্ত করতে পারি উপনিবেশ ও উপনিবেশাত্তর সকল রচনাকে। বর্তমানের নব্যউপনিবেশবাদের ভাবাদর্শে সাহিত্য-সংস্কৃতি রচিত হচ্ছে কিনা তাও অনুধাবনের দৃষ্টিকোণ তৈরি করতে পারি। হয়ত বা এভাবে গড়ে তুলতে পারি আমাদের নিজস্ব এক সাহিত্যতত্ত্ব প্রন্থভুক্ত লেখাগুলিতে তাই তত্ত্ব ব্যাখ্যায় দৃষ্টান্ত ব্যবহার করা হয়েছে বাংলা সাহিত্য থেকে। এইসব ধারণা ও মনোভাব থেকেই বর্তমান গ্রন্থটি সংকলিত হয়েছে। কারণ আমরা সমালোচনা তত্ত্বে বিজ্ঞানের নিয়ম মান্যকরণে বিশ্বাসী। কোয়ন্টাম বিজ্ঞান যেমন জানায় যে একটি বস্তুকণিকা শুধু একটিমাত্র তত্ত্ব দিয়ে ব্যাখ্যা করা যায় না, তার একটি মাত্র ইতিহাস থাকে না, কণিকাটি চলার পথে যেকোনো বা সকল সম্ভব্য পথ বেছে নিতে পারে। একইসঙ্গে দুটি বা তিনটি তাতে সংঘর্ষশীলও হতে পারে মিত্রতাও গড়তে পারে, তেমনি সাহিত্য সমালোচনাও সম্ভাব্য সকল তত্ত্বই প্রয়োগ করতে পারে, একসঙ্গে দুটি তিনটিও। নন্দনতত্ত্বের সীমানাও ভেঙে পড়ছে মহাজাগতিক জ্ঞান ও বিজ্ঞান দৃষ্টির প্রসারতার সঙ্গে-সঙ্গে। কোনো একটি তত্ত্ব দিয়ে সাহিত্য ব্যাখ্যা করে তাতে ছাপ মেরে দেয়াটাও ধর্মবিশ্বাসীদের সৃষ্টিরহস্য সমাধান করে ফেলার মতোই ব্যাপার।
No comments