নাটকঃ কীত্তনখোলা । লেখকঃ (সেলিম আল দীন ) রিভিও

কিত্তনখোলা ২০০০ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত একটি বাংলাদেশী চলচ্চিত্র। ছবিটি পরিচালনা করছেন খ্যাতিমান চলচ্চিত্রকার আবু সাইয়ীদ। নাট্যাচার্য সেলিম আল দীন রচিত কিত্তনখোলা নাটক অবলম্বনে চলচ্চিত্রটির চিত্রনাট্য ও সংলাপ লিখেন পরিচালক আবু সাইয়ীদ ও নুরুল আলম আতিক। এটি প্রযোজনা প্রতিষ্ঠান ইমপ্রেস টেলিফিল্ম এর ব্যানারে নির্মাণ করা হয়। এটি ১৬ মিমি ফরম্যাটে নির্মিত চলচ্চিত্র,
যদিও পরে এটি ৩৫ মিমি-এ প্রতিস্থাপন করে প্রেক্ষাগৃহে মুক্তি দেয়া হয়। ছবিটির উল্লেখযোগ্য চরিত্র গুলোতে অভিনয় করেছেন রাইসুল ইসলাম আসাদ, জয়ন্ত চট্টোপাধ্যায়, মামুনুর রশীদ, পীযুষ বন্দোপাধ্যায়, নায়লা আজাদ নুপুর, তমালিকা কর্মকার,
ও আজাদ আবুল কালাম
ফসল মাড়াই শেষ হলে নদীতীরে মেলা আয়োজন করা হয়। মেলার প্রধান আকর্ষণ "আদি মহুয়া অপেরা" যাত্রাদল। যাত্রাদলের প্রধান সুবল দাস তার দলবল নিয়ে মেলায় পৌঁছে। স্থানীয় ঠিকাদার ইদু কন্ট্রাক্টর মেলার ইজারা নিয়েছে। সে তাদের বরণ করে নেয়। গ্রামের যুবক সোনাই মেলায় ঘুরার সময় ইদুর লোক তাকে তার জমি নিয়ে ইদুর সাথে কথা বলতে এলে সে পালিয়ে যায়। মেলায় তার যাত্রাদলের ছায়া রঞ্জনের সাথে মদ খেতে গিয়ে ভালো সম্পর্ক গড়ে উঠে। মদ খাওয়ার এক পর্যায়ে তার মৃগী রোগ দেখা দিলে তার বন্ধু রুস্তম তাকে বেদে কন্যা ডালিমনের কাছে নিয়ে যায় ঔষধের জন্য। ডালিমনের দেওয়া তাবিজে সোনাইয়ের মৃগী রোগ থেকে নিস্তার পায়। সে ভালোবেসে ফেলে ডালিমনকে।
যাত্রাদলের অভিনেত্রী বনশ্রীবালার প্রতি ইদুর চোখ পড়ে। যাত্রাদলের মালিক সুবল দাস দলকে ঠিকেয়ে রাখতে বনশ্রীবালাকে ইদুর কাছে পাঠাতে চায়। অভিনেতা রবি দাস এর প্রতিবাদ করে এবং এতিম শিশু ছায়ারঞ্জনকে সুবলের দলে স্থান দেওয়া ও তার ওপর যৌন নির্যাতনেরও কথা তুলে আনে। ছায়া মদ খেয়ে তার জীবনের ঘটে যাওয়া সবকিছু ভুলে থাকতে চায়। রবি ও ছায়া দুজনই বনশ্রীকে ভালোবাসে। বনশ্রীও জীবনে থিতু হতে চায়। কিন্তু পতিতাপল্লি থেকে আসা যাত্রা-অভিনেত্রীর স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসা হয় না। ইদুর লালসা এড়াতে আত্মহত্যা করে বনশ্রী। সোনাইও পায় না ডালিমনকে। বেদে-সমাজের কঠোর নিয়ম-অনুশাসন তাদের এক হতে দেয় না। ইদুর লোকের প্ররোচনায় জুয়া খেলে সর্বস্ব হারায় সোনাই। সোনাইয়ের বন্ধকের জমিটা এবার পুরোপুরি হাতে চলে যায় ইদুর হাতে।
এক.
সেলিম আল দীন (১৯৪৯-২০০৮) বাংলাদেশের নাট্যধারায় অভিনব আঙ্গিক সংযোজন করে স্বীয় স্বাতন্ত্র্যের পরিচয় দিয়েছেন। গবেষণা (মধ্যযুগের বাঙলা নাট্য) করতে গিয়ে সেলিম আল দীন মধ্যযুগের বাঙালি সংস্কৃতির সাথে ঘনিষ্ঠভাবে সম্পৃক্ত হয়েছিলেন। এ সময় প্রাচীন বাংলার ইতিহাস-ঐতিহ্যের নানা অনুষঙ্গের প্রতি তিনি আকৃষ্ট হন। উপরন্তু সেলিম আল দীনের শৈশব-কৈশোর উপকূল অঞ্চল ঘেঁষা মানুষের জীবন-সংস্কৃতির সাথে ওতোপ্রতোভাবে যুক্ত ছিল। ফলে তাঁর জীবনাভিজ্ঞতায় বাংলা জনপদের প্রান্তিক জনমানুষের ঐতিহ্য-সংস্কৃতি তথা শেকড়ের টান ছিল। তিনি বাঙালি জাতির প্রাচীন ঐতিহ্যের সাথে নাড়ীর যে সম্পর্ক গড়ে তুলেছেন, নাটকে তিনি সেই ঐতিহ্যকেই প্রকাশ করেছেন। সেলিম আল দীন বিশ্বাস করতেন, বাংলা জনপদের মানুষের জীবনাচরণে আছে নাটকীয় উপাদান। প্রান্তিক মানুষের নিত্যকার যাপিত জীবনকথা সেলিম আল দীন তাঁর নাটকের বিষয় হিসেবে গ্রহণ করেছেন। প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর জীবনাচরণ অবিকল উপস্থাপন করে সেলিম আল দীন বাংলা নাটকে একাধারে স্বীয় স্বাতন্ত্র্যের পরিচয় যেমন দিয়েছেন তেমনি বিশেষ স্থান দখল করে নিয়েছেন। তিনি নিজে তাঁর রচনাদিকে বিশেষ কোনো সাহিত্য শাখার অন্তর্ভুক্ত করার পক্ষপাতী নন। তাঁর পাঠকের ওপর ছেড়ে দিয়েছেন তাঁর রচনা সাহিত্যের কোন শাখার অন্তর্ভুক্ত হবে তা নির্ধারণ করার জন্য। সেলিম আল দীন বনপাংশুল-এর ভূমিকায় এটিকে উপাখ্যান, নাটক, গাথাকাব্য যেকোনো নামেই পাঠকের গ্রহণের স্বাধীনতার কথা উল্লেখ করেছেন। তাঁর চাকা নাটক সম্পর্কে এক মন্তব্যে সব্যসাচী লেখক সৈয়দ শামসুল হক উল্লেখ করেন- সেলিম আল দীন এই কথানাট্যের রচয়িতা, বাংলা নাটকের এক প্রধান পুরুষ; সেলিম অনবরত সন্ধান করে চলেন প্রকাশের নতুনতর মার্গ; নতুন,কিন্তু বাংলা ভাষার সৃষ্টি এবং হাজার বছরের ধারাবাহিকতার অন্তর্গত অবশ্যই।১
সেলিম আল দীন (১৯৪৯-২০০৮) বাংলাদেশের নাট্যধারায় অভিনব আঙ্গিক সংযোজন করে স্বীয় স্বাতন্ত্র্যের পরিচয় দিয়েছেন। গবেষণা (মধ্যযুগের বাঙলা নাট্য) করতে গিয়ে সেলিম আল দীন মধ্যযুগের বাঙালি সংস্কৃতির সাথে ঘনিষ্ঠভাবে সম্পৃক্ত হয়েছিলেন। এ সময় প্রাচীন বাংলার ইতিহাস-ঐতিহ্যের নানা অনুষঙ্গের প্রতি তিনি আকৃষ্ট হন। উপরন্তু সেলিম আল দীনের শৈশব-কৈশোর উপকূল অঞ্চল ঘেঁষা মানুষের জীবন-সংস্কৃতির সাথে ওতোপ্রতোভাবে যুক্ত ছিল। ফলে তাঁর জীবনাভিজ্ঞতায় বাংলা জনপদের প্রান্তিক জনমানুষের ঐতিহ্য-সংস্কৃতি তথা শেকড়ের টান ছিল। তিনি বাঙালি জাতির প্রাচীন ঐতিহ্যের সাথে নাড়ীর যে সম্পর্ক গড়ে তুলেছেন, নাটকে তিনি সেই ঐতিহ্যকেই প্রকাশ করেছেন। সেলিম আল দীন বিশ্বাস করতেন, বাংলা জনপদের মানুষের জীবনাচরণে আছে নাটকীয় উপাদান। প্রান্তিক মানুষের নিত্যকার যাপিত জীবনকথা সেলিম আল দীন তাঁর নাটকের বিষয় হিসেবে গ্রহণ করেছেন। প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর জীবনাচরণ অবিকল উপস্থাপন করে সেলিম আল দীন বাংলা নাটকে একাধারে স্বীয় স্বাতন্ত্র্যের পরিচয় যেমন দিয়েছেন তেমনি বিশেষ স্থান দখল করে নিয়েছেন। তিনি নিজে তাঁর রচনাদিকে বিশেষ কোনো সাহিত্য শাখার অন্তর্ভুক্ত করার পক্ষপাতী নন। তাঁর পাঠকের ওপর ছেড়ে দিয়েছেন তাঁর রচনা সাহিত্যের কোন শাখার অন্তর্ভুক্ত হবে তা নির্ধারণ করার জন্য। সেলিম আল দীন বনপাংশুল-এর ভূমিকায় এটিকে উপাখ্যান, নাটক, গাথাকাব্য যেকোনো নামেই পাঠকের গ্রহণের স্বাধীনতার কথা উল্লেখ করেছেন। তাঁর চাকা নাটক সম্পর্কে এক মন্তব্যে সব্যসাচী লেখক সৈয়দ শামসুল হক উল্লেখ করেন- সেলিম আল দীন এই কথানাট্যের রচয়িতা, বাংলা নাটকের এক প্রধান পুরুষ; সেলিম অনবরত সন্ধান করে চলেন প্রকাশের নতুনতর মার্গ; নতুন,কিন্তু বাংলা ভাষার সৃষ্টি এবং হাজার বছরের ধারাবাহিকতার অন্তর্গত অবশ্যই।১
সুতরাং একটা বিষয় খুব স্পষ্ট যে,
সেলিম আল দীন নাটক রচনা করতে গিয়ে যেমন বিশেষ রচনাকৌশল গ্রহণ করেছেন,
তেমনি এর বিষয়বস্তুও তিনি গ্রহণ করেছেন বাংলা জনপদের প্রান্তিক জনমানুষের (গ্রাস রুট লেবেল) জীবন-যাপন,
আচার-আচরণ,
সংস্কৃতি থেকে।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা-উত্তর নাট্যাঙ্গনে সেলিম আল দীন অসমান্য কৃতিত্বের দাবীদার। তাঁকে বাংলাদেশের নাটকের অন্যতম প্রধান পুরুষ হিসেবে আখ্যায়িত করলেও অত্যুক্তি হয় না। সমকালীন সাহিত্যে,
বিশেষত নাটকে তাঁর পাণ্ডিত্য,
জীবনবোধের গভীরতায়,
আঙ্গিক সচেতনতা সর্বোপরি নাট্য-নিরীক্ষা ঈর্ষণীয়। সেলিম আল দীন বাংলা নাটকের শেকড় সন্ধান করেছেন,
বাঙালির ইতিহাস-ঐতিহ্য আর সংস্কৃতির ভেতর। তিনি খুঁজে পেয়েছেন বাঙালির স্বীয় নাট্যকৌশল। তাঁর নাট্য-প্রকরণ সম্পর্কে সমালোচকের কথা এরকম-
অধরা শিল্পের নিত্য পূজায় ধ্যানমগ্ন শিল্পীর চৈতন্যে অনুক্ষণ এক সুর খেলে।
অস্তিত্বের বীণা তারে- বাণীর দেবী ঝংকার তোলেন নবরূপে বিচিত্র ভঙ্গিমায়।
অস্তিত্বের বীণা তারে- বাণীর দেবী ঝংকার তোলেন নবরূপে বিচিত্র ভঙ্গিমায়।
মূর্ত-বিমূর্তের জগতে তাঁর সার্বক্ষণিক বিচরণভূমি। শিল্পের সৃজন-কর্ম সে-জন্যেই সাধন সত্য। প্রকৃত শিল্পী তাঁর নন্দনবিশ্বে মগ্নচিত্ত সাধক। সেলিম আল দীন সাধক শিল্পী-শিল্পের ব্রতচারী। একনিষ্ঠ সাধকের প্রাত্যহিক কৃত্যের অপরিহার্যতার তুল্য তাঁর শিল্প সৃজন কৃত্য।২
নাট্যকার সেলিম আল দীন শুরু থেকেই পাশ্চাত্য নাট্য-প্রকরণ ত্যাগ করে বাঙালির নিজস্ব নাট্য-কৌশল অবলম্বনে প্রয়াসী হয়েছেন। তারপরও দেখা যায় তাঁর প্রথম দিকের কয়েকটি নাটকে পাশ্চাত্য নাটকের প্রভাব আছে। তবে অল্প-সময়ের মধ্যেই তিনি পাশ্চাত্য প্রভাব-বলয়ের বাইরে বেরিয়ে বাঙালি সমাজের নিজস্ব গল্প এবং যাপিত জীবনের নাটকীয় উপাদান সংগ্রহ করেন;
যা তিনি কিত্তনখোলা,
কেরামতমঙ্গল,
হরগজ, হাতহদাই, চাকা, যৈবতী কন্যার মন- প্রভৃতি নাটকে তুলে ধরেছেন। তাঁর নাট্য-কৌশল নির্মাণ প্রসঙ্গে সমালোচক বলেন-
এ যাবৎ কাল ধরে আমরা যে ইউরোপীয় একক নন্দন ভাবনার আওতায় ছিলাম,
তিনি তার মধ্যে নিজেকে বিলীন করেন নি,
তিনি বাঙালির সাংস্কৃতিক বিশিষ্টতা ও যৌথ অবচেতনার জগৎকে বিনির্মাণ করে চলেছেন তাঁর কাজে,
তাঁর পাঠকৃতিতে। এবং এই সূত্রে তিনি আমাদের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যকে শুধু পুনর্নির্মাণই করছেন না,
তাকে উন্নীতও করছেন। তাঁর কাজে যে স্ট্রাকচারাল এপিকের লক্ষণ দৃষ্ট হয়,
তা তাঁকে আজ ভিন্ন বাচনে তুলে ধরতে বাধ্য করে।৩
বলার অপেক্ষা রাখে না যে,
সেলিম আল দীনের নাটকে বঙ্গভূমি এবং বাঙালির ইতিহাস-ঐতিহ্য-সংস্কৃতির পুনর্বিন্যাস যেমন তিনি করেছেন,
তেমনি তিনি এ জনপদের ভূমি-সংলগ্ন মানুষের জীবনবৃত্তান্ত নাট্যকাহিনীতে উপস্থাপন করেছেন। তাঁর রচিত নাটকের কাহিনী মহাকাব্যিক বিশালতা হোমারের ইলিয়াড-ওডেসির কথা স্মরণ করিয়ে দেয়। তিনি বাঙালি জাতিকে তার সমৃদ্ধ সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের কথা স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন। তিনি প্রাচ্যের সাংস্কৃতিক সমৃদ্ধ ঐতিহ্যের প্রতি আস্থাশীল ছিলেন এবং বিশ্বাস করতেন বাঙালির নিজস্ব জীবনের গাথাই নাটকের নবতর নির্মাণে সহায়ক হতে পারে। তিনি তাঁর বিশ্বাসকে শক্তিতে রূপান্তরিত করেছেন। সেলিম আল দীন দেশীয় ঐতিহ্যের শেকড়ের সন্ধানে আগ্রহী ছিলেন। ‘ঢাকা থিয়েটার’-এর সাথে নাট্যকার সেলিম আল দীনের যে সেতু বন্ধন,
সেখানে খুঁজে পাওয়া শেকড় সন্ধানী শিল্পচেতনা। ‘ঢাকা থিয়েটার’-এর ‘মটো’ বা স্লোগান হচ্ছে-
বাংলাদেশ একটি সংগ্রাম ক্ষুব্ধ অকুতোভয় জনপদের নাম। যুদ্ধ ঝড় জলোচ্ছ্বাসের মধ্যে এই জনপদ সমুন্নত জীবনের আকাক্সক্ষাকে প্রজ্জ্বলিত করেছে তার সামুদ্রিক দুই চোখে। এই দেশ,
তার ইতিহাস,
সংগ্রাম, সংস্কৃতি, সবকিছুকে আমরা সম্মান করি। পদ্মা,
মেঘনা, যমুনা, তিস্তা, আত্রাই, ধরলার কূলে কূলে নামহীন গোত্রহীন মানুষের সংগ্রামী জীবন আমাদের নাটকের
বিষয়বস্তু।৪
‘ঢাকা থিয়েটার’-এর প্রতিপাদ্য বক্তব্যের সাথে সেলিম আল দীন-এর সম্পর্ক গভীর। তিনি যেসব নাটক রচনা করেছেন,
তা যেন ‘ঢাকা থিয়েটার’-এর বক্তব্যেকে সামনে রেখে। অর্থাৎ ‘ঢাকা থিয়েটার’-এর স্লোগান এবং সেলিমের নাটকের বিষয়-প্রেক্ষাপট সমার্থক-সমান্তরাল। যেমন- তিনি হরগজ-এ এঁকেছেন ঘূর্ণিঝড়ে বিধ্বস্ত এক গ্রাম্য জনপদের উৎক্ষিপ্ত চিত্র। কিত্তনখোলা-য় বহমান বেদে সমাজের এবং তাদের যাপিত জীবনের অসাধারণ এক অনন্য সাধারণ গল্পভাষ্য উপস্থাপন করেছেন। কেরামতমঙ্গল-এ দেখিয়েছেন গ্রাম-বাংলার সহজ-সরল মানুষের নানামুখী সংকট এবং উত্তরণের প্রয়াস চিত্র। অথবা চাকা নাটকের বেওয়ারিশ লাশের সাথে দুই গাড়োয়ানের আত্মিক সম্পর্ক সৃষ্টি করে তার শেষকৃত্য সম্পন্ন করেছেন।
সেলিম আল দীন রচিত নাটকের সংখ্যা অনেক। তিনি যখন নাটক রচনায় হাত দিয়েছিলেন,
তখন প্রথাগত ইউরোপীয় নাট্য-প্রভাব তাঁর ভেতর ছিল। তবে শুরু থেকেই তিনি বাংলা নাট্য-সাহিত্যকে ইউরোপীয় নাট্য-প্রভাব থেকে বের করে আনার জন্য সক্রিয় হয়েছিলেন। তিনি
সমগ্র নাট্য-জীবনব্যাপী সচেষ্ট ছিলেন- বাংলা নাটকে বাঙালি উপাদান ব্যবহার করে বাঙালিয়ানার প্রকাশ করতে। প্রথম-পর্বের অল্প কয়েকটি নাটকে তিনি সম্পূর্ণ ইউরোপীয় নাট্য-প্রভাব কাটিয়ে উঠতে না পারলেও দ্বিতীয় পর্বের নাটকে সাফল্য অর্জন করেছেন। একথা সত্য যে,
সেলিম আল দীন-এর নাট্য-প্রতিভার প্রকৃত পরিচয় এই দ্বিতীয় পর্বের নাটক থেকেই শুরু হয়েছিল। এ পর্বেই সেলিম আল দীন নাটকে নিয়ে আসেন বাঙালির জীবন,
ইতিহাস, ঐতিহ্য, সংস্কৃতি প্রভৃতির স্বাদ-গন্ধ;
উপরন্তু এ সময় থেকে তাঁর নাট্য-পরিবেশনাতে ছিল ভিন্নতা;
যে উপস্থাপন কৌশলে ছিল বাঙালিয়ানার ছাপ।
নাট্যকার সেলিম আল দীন-এর নাট্য-চেতনার ভুবন গড়ে উঠেছে আবহমান বাংলা জনপদের সমৃদ্ধ সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের স্পর্শে। সম্ভবত এ কারণেই কোনো না-কোনোভাবে তাঁর নাটকে বাংলার পশ্চাদপদ তথা অন্ত্যজ মানুষের জীবন-কথাই প্রাধান্য লাভ করেছে। প্রথম পর্বের নাটকে
সেলিম স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশের আর্থ-সামাজিক-রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক সমস্যা উপস্থাপনে প্রয়াসী ছিলেন। জণ্ডিস ও বিবিধ বেলুন-এ ফকিরের কান্না,
বেকারের চিৎকার,
ক্ষুধার্তের মিছিল প্রকৃতার্থে স্বাধীন বাংলাদেশের আর্থিক বৈষম্যের চিত্র। সর্প বিষয়ক গল্প নাটকে দেশের রাজনৈতিক অনিশ্চিত ভবিষ্যৎ এবং অস্থিরতার যে চিত্র নাট্যকার তুলে ধরেছেন,
সেই বাস্তবতায় সাধারণ মানুষের বেঁচে থাকার মৌলিক অধিকার নিয়েও সংশয়-অনিশ্চয়তা জেগেছে। এক্সপ্লোসিভ ও মূল সমস্যা-য় নাট্যকার সেলিম সমকালীন ব্যবসায়ী মহলের নৈতিক অধঃপতনের চিত্র তুলে ধরতে গিয়ে কালোবাজারী,
খাদ্যে ভেজাল,
সন্ত্রাসীদের বোমা তৈরির ঘটনা এনেছেন।
স্বংাদ কার্টুন-এ সেলিম আল দীন স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক নৈরাজ্য ও
অনিশ্চয়তার চিত্র তুলে ধরে ব্যঙ্গ-বিদ্রুপ করেছেন। মুনতাসীর-এ নাটকের শ্লেষ ও ব্যঙ্গাত্মক উপস্থাপনা সংবাদ কার্টুন-এর কথা মনে করিয়ে দেয়। মুনতাসীর নাটকের নায়ক এক সর্বভূক চরিত্র। মুনতাসীরের অন্তহীন ক্ষুধা এবং তা নিবারণে তার নির্বিচারে খাদ্য গ্রহণের দৃশ্য নাট্যকার জাদু-বাস্তবতায় উপস্থাপন করেছেন। মুনতাসীরের নির্বিচারে খাদ্য গ্রহণে সে অসুস্থ হয়ে পড়লে,
তাকে অপারেশন করা হয়। এ সময় নাট্যকার দেখান মুনতাসীর খেয়েছে দড়ি,
বেলুন, ব্রেসিয়ার, কাগজ, শাড়ি, অয়েলপেইন্ট, ক্লিপ প্রভৃতি। নাট্যকার সেলিম আল দীন মুনতাসীরের এই নির্বিচার খাদ্য গ্রহণের মধ্য দিয়ে প্রকৃতার্থে বাংলাদেশের আর্থ-সামাজিক-রাজনৈতিক বাস্তবতার ইঙ্গিত করেছেন। মূলত তাঁর আক্রমণের মূল লক্ষ্য যারা রাষ্ট্রক্ষমতা অপব্যবহার করে রাষ্ট্রীয় অর্থ-সম্পদ আত্মসাৎ করেছে,
তারা। ফলে অন্যভাবে বলা যায়,
যাদের ব্যক্তিস্বার্থে রাষ্ট্রীয়
অর্থ-সম্পদের অপচয় হয়েছে- এ নাটকে তাদের-ই ব্যঙ্গ-কার্টুন এঁকেছেন নাট্যকার।
অর্থ-সম্পদের অপচয় হয়েছে- এ নাটকে তাদের-ই ব্যঙ্গ-কার্টুন এঁকেছেন নাট্যকার।
দুই.
সেলিম আল দীন-এর করিম বাওয়ালির শত্রু অথবা মূল মুখ দেখা নাটকে প্রথমবারের মতো প্রান্তিক জনসমাজ ও তাদের জীবনের গল্পচিত্র উপস্থাপিত হয়েছে। নাটকের করিম বাওয়ালি ও তার স্ত্রী পাবদা প্রান্তিক জনমানুষ। করিমের পেশা মৌমাছির চাক থেকে মধু সংগ্রহ করা; এ কারণে তার নামের সাথে যুক্ত হয়েছে ‘বাওয়ালি’। করিম বাওয়ালির জীবিকা নির্বাহের উপায় ক্রমশ ক্ষীণ হয়ে আসছে। কারণ, একশ্রেণীর মানুষের সুখ-স্বাচ্ছন্দ্যের জন্য সুন্দর বনের বৃক্ষ নিধন করা হচ্ছে। ফলে বন না থাকলে প্রান্তিক মানুষ করিম বাওয়ালির জীবিকা নির্বাহের উপায় বন্ধ হয়ে যাবে। অন্যদিকে প্রাকৃতিক সৌন্দর্য হারিয়ে পরিবেশও হুমকির সম্মুখীন হবে। এর ফলে ক্ষতিগস্ত হবে নিম্নবিত্তের মানুষ। বিশেষত করিম বাওয়ালির মতো নিম্নপেশা-বিত্তের মানুষ।
সেলিম আল দীন-এর করিম বাওয়ালির শত্রু অথবা মূল মুখ দেখা নাটকে প্রথমবারের মতো প্রান্তিক জনসমাজ ও তাদের জীবনের গল্পচিত্র উপস্থাপিত হয়েছে। নাটকের করিম বাওয়ালি ও তার স্ত্রী পাবদা প্রান্তিক জনমানুষ। করিমের পেশা মৌমাছির চাক থেকে মধু সংগ্রহ করা; এ কারণে তার নামের সাথে যুক্ত হয়েছে ‘বাওয়ালি’। করিম বাওয়ালির জীবিকা নির্বাহের উপায় ক্রমশ ক্ষীণ হয়ে আসছে। কারণ, একশ্রেণীর মানুষের সুখ-স্বাচ্ছন্দ্যের জন্য সুন্দর বনের বৃক্ষ নিধন করা হচ্ছে। ফলে বন না থাকলে প্রান্তিক মানুষ করিম বাওয়ালির জীবিকা নির্বাহের উপায় বন্ধ হয়ে যাবে। অন্যদিকে প্রাকৃতিক সৌন্দর্য হারিয়ে পরিবেশও হুমকির সম্মুখীন হবে। এর ফলে ক্ষতিগস্ত হবে নিম্নবিত্তের মানুষ। বিশেষত করিম বাওয়ালির মতো নিম্নপেশা-বিত্তের মানুষ।
করিম বাওয়ালির জীবন-বাস্তবতায় সেলিম আল দীন একদিকে প্রাচীন প্রাকৃতিক সৌন্দর্য ধ্বংস হয়ে যাওয়ার ইঙ্গিত যেমন দিয়েছেন,
তেমনি সেই প্রকৃতির ওপর নির্ভরশীল প্রান্তিক মানুষের অস্তিত্বের হুমকি-চিত্রও অঙ্কন করেছেন। বনের গাছ যত কমতে থাকে করিম বাওয়ালির জীবিকা-উপার্জনের ক্ষেত্র তত কমে;
এক সময় জীবন সংকটাপন্ন হয়ে পড়ে। তখন করিম বাওয়ালির পক্ষে জীবিকা নির্বাহের জন্য মহাজনের কাছ থেকে চড়া সুদে ঋণ গ্রহণ ছাড়া গত্যন্তর থাকে না। কিন্তু করিম মহাজনের ঋণ পরিশোধ করবে কীভাবে?
বন থেকে যদি সে মধু আহরণ করতে না পারে,
তাহলে ঋণ পরিশোধ করা দূরে থাক,
প্রাত্যহিক জীবনের রুটিরুজিও তার বন্ধ হয়ে যাবে। করিম বাওয়ালির পক্ষে জীবন নির্বাহ করা সম্ভব হবে না। তার দৃষ্টান্ত স্বরূপ নাট্যকার দেখিয়েছেন,
করিম বাওয়ালির স্ত্রী পাবদা অনাহারে থেকে অবশেষে কলেরায় আক্রান্ত হয়ে বিনা চিকিৎসায় মারা গেছে। এই সহায়-সম্বলহীন করিম বাওয়ালি এবং তার পরিবার বেঁচে ছিল,
প্রকৃতির ওপর নির্ভর করে। তাই নাট্যকার দেখান,
যখন প্রকৃতি উজাড় হচ্ছে তখন করিম বাওয়ালির মতো প্রকৃতির ওপর নির্ভরশীল প্রান্তিক মানুষের জীবনও সংকটাপন্ন হয়ে ওঠে। করিম বাওয়ালি তার স্ত্রীর মৃত্যুতে শোকে-যন্ত্রণায় নিষ্ফল হুংকার দেয় মহাজনের বিরুদ্ধে।
করিম বাওয়ালির এই মর্মান্তিক পরিণতির জন্য দায়ী প্রকৃতার্থে মানুষের সামাজিক সভ্যতা এবং নগর-সভ্যতা। মানব-সভ্যতা ক্রমান্বয়ে সামনের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে আর নির্বিচারে প্রকৃতির ওপর অত্যাচার করছে। মানুষ অবলীলায় প্রকৃতির ঐশ্বর্য ধবংস করে ফেলছে। ভাবছে আগামী দিনের তথা ভবিষ্যৎ পরিণামের কথা। বিজ্ঞানীরা সাম্প্রতিক গবেষণায় দেখিয়েছেন,
কোনোভাবেই প্রাকৃতিক সম্পদ ধ্বংস করা যাবে না। অন্যথায় পরিবেশ তার ভারসাম্য হারিয়ে ফেলবে;
প্রকৃতি যদি তারা ভারসম্যা হারিয়ে ফেললে পরিণামে মানুষের জীবনে নেমে আসবে নানা বিপদ-বিপর্যয় ও সংকট-সমাস্যা। এক করিম বাওয়ালির স্ত্রীর মৃত্যুর মধ্য দিয়ে প্রকৃতির ওপর নির্ভরশীল প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর মর্মান্তিক জীবনচিত্র তুলে ধরেছেন। ‘প্রচণ্ড বিশ্বাস ছিল সেলিমের নিজেদের সংস্কৃতির শক্তির ওপর। তাইতো গ্রামীণ জীবনের নানা লোকাচার ও উপাদান তাঁর রচনায় এতো গুরুত্বপূর্ণ জায়গা দখল করে আছে। সেলিমের কাছে মানুষের মতো প্রকৃতিও একটা বড় চরিত্র। প্রকৃতিকে অস্বীকার করে মানুষের অস্তিত্বে সেলিম বিশ্বাস করতেন না।’৫
আতর-আলীদের নীলাভ পাট নাটকে সেলিম আল দীন বাংলা জনপদের কৃষক সমাজের জীবনচিত্র উপস্থাপন করেছেন। নাটকে তিনি পাট-চাষীদের দৈনন্দিন জীবনের সুখ-দুঃখ,
হাসি-কান্না,
আনন্দ-কষ্ট এবং চাষীদের বিশ্বাস-সংস্কারের কথার পাশাপাশি কৃষক সমাজের ওপর মহাজনদের শোষণের কথাও ব্যক্ত করেছেন। পাট বিক্রিকে কেন্দ্র করে আতর আলীর সঙ্গে মহাজনের কর্মচারীর দ্বন্দ্ব চরমে পৌঁছে। সরকারি গোডাউনে বিক্রি করলে ন্যায্য দাম কৃষকরা পায়। নাট্যকার দেখিয়েছেন,
মহাজনের নির্ধারিত মূল্যেই পাট বিক্রি করতে বাধ্য হয় চাষীরা। কারণ,
মহাজনের কাছ থেকে পূর্বে চাষীরা ঋণ নিয়েছে জীবন-জীবিকার স্বার্থে। মহাজনের সুদের টাকা পরিশোধ করতে হয় তাদেরকে পাট দিয়ে। ফলে চাষীরা সরকারের কাছে ন্যায্যমূলে পাট বিক্রি করতে পারে না। প্রান্তিক কৃষক তার উৎপাদিত ফসলের ন্যায্য দাম থেকে বঞ্চিত হয়।
মহাজনের শোষণের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছে আতর আলী। পাট কাটতে গিয়ে ডান হাতের আঙ্গুল কাটা পড়ে আতর আলীর,
পচা আঙ্গুলের চিকিৎসা,
পথ্য, খাদ্য প্রভৃতি সংকটে আতর আলীর নাভিশ্বাস উঠেছে,
তথাপি সে মহাজনের আড়তে পাট বিক্রি করতে অস্বীকার করেছে। তার কণ্ঠের সাথে একাত্মতা প্রকাশ করেছে গ্রামের অন্য পাট-চাষীরা। সকল পাট-চাষী মিলে মহাজনের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলার চেষ্টা করেও ব্যর্থ হয়েছে। এভাবেই বাংলা জনপদের নিম্ন-শ্রেণীর মানুষ কৃষকরা মহাজন,
ফড়িয়া, মধ্যস্বত্ত্বভোগীদের কাছে চিরকাল শোষণ শাসনের শিকার হয়েছে। এই শোষণের চালচিত্র আতর-আলীদের নীলাভ পাট রচনার মধ্য দিয়ে সেলিম আল দীন প্রান্তিক জনগণের যাপিত জীবনচিত্র দক্ষতার সাথে মঞ্চস্থ করেছেন। নাট্যকার প্রথম-পর্বের নাট্যকাহিনী ক্রমশ শহর থেকে গ্রাম জীবনের দিকে ধাবিত করেছেন এবং আগ্রহান্বিত হয়েছেন। তিনি নাটকে নিঃস্ব,
দ্রারিদ্র্য-পীড়িত আর্থ-সামাজিক-রাজনৈতিক জনমানুষের জীবনের দ্বন্দ্ব-সংঘাতকে রঙ্গমঞ্চের আলোয় ফুটিয়ে তুলেছেন। সমালোচকের মন্তব্য তাই
‘শহুরে ছোট অভিজ্ঞতার বাইরে দেশের ব্যাপ্ত মানুষের সুখ দুঃখ,
তাদের মুখের আঞ্চলিক ভাষা,
তাদের জীবনের বাস্তব ও সাংস্কৃতিক পরিচয় এবং এই সমস্তকে ঘিরে যে বড় পট আঁকার চেষ্টা তিনি অচিরেই শুরু করবেন।’৬
নাট্যকার সেলিম আলী দীন প্রথম-পর্বের নাট্যগণ্ডী পার হয়ে স্বভূমির দারিদ্র্য-পীড়িত গ্রাম-বাংলার নিম্নবিত্তের জীবনচিত্র নাট্যকাহিনীতে উপস্থাপনে সচেষ্ট হয়েছেন। দ্বিতীয়-পর্বের নাটকগুলোতেই সেলিম আল দীনের নাটকের মানুষজনদের নানামাত্রিক পরিচয় তিনি যথেষ্ট দক্ষতার সাথে তুলে ধরতে প্রয়াসী হয়েছেন। সেলিম আল দীনের নাট্য-পরিক্রমা মূলত স্ব-জাতির শেকড়ের অনুসন্ধান প্রক্রিয়া। ক্রমাগত নাট্যকার এগিয়ে চলেছেন আকাক্সিক্ষত বিষয়চেতনার দিকে এবং তাঁর বিষয়-প্রেক্ষাপট নাটকের নব-আঙ্গিক নির্মাণের পথ দেখিয়েছে। দ্বিতীয় পর্বের উল্লেখযোগ্য নাটকগুলো হচ্ছে
শকুন্তলা,
কেরামতমঙ্গল,
চাকা। এ পর্বের নাটকে নিম্নবিত্তের মানুষের জীবন তথা বাঙালি জীবনের চিত্র নাট্যকার সেলিম আল দীন অসাধারণ দক্ষতায় সম্পূর্ণ নিজস্ব আঙ্গিক-কৌশলে উপস্থাপন করেছেন। বলার অবকাশ রাখে না যে,
বক্ষমান নিবন্ধের মূল লক্ষ্য সেলিম আল দীনের নাটকে চিত্রিত প্রান্তিক জন-মানুষের উপস্থাপন মূল্যায়ন করা। এই বিবেচনায় শকুন্তলা আমাদের আলোচনার অন্তর্ভুক্ত নয়।
তিন.
কিত্তনখোলা রচনার মধ্য দিয়ে সেলিম আল দীন নাট্যকার হিসেবে প্রাচ্যচেতনায় তথা বাঙালির নিজস্ব প্রকরণশৈলী নির্মাণ করেন। করিম বাওয়ালির শত্র“ অথবা মূল মুখ দেখা দিয়ে সেলিম আল দীন প্রাচীন বাংলা জনপদ ও প্রান্তিক গ্রামীণ মানুষের প্রতি যাত্রা শুরু করেন। তুলে আনেন বাঙালি জীবনের নিজস্বতা এবং প্রথাগত সমাজের জীবন-যাপনের রীতি-পদ্ধতি, আচার-আচরণ সাংস্কৃতিক চিত্রের ইতিকথা। নাট্যকার সূক্ষ্ম দৃষ্টিতে দেখেছেন, উপলব্ধি করেছেন এবং তা জীবন-রঙ্গমঞ্চের বাস্তবতা থেকে থিয়েটার হলের দর্শকদের রঙ্গমঞ্চে নিয়ে এসেছেন। তিনি বাঙালি জীবন ও সমাজের যে চিত্র নাট্যানুষঙ্গে তুলে ধরেছেন, তা বাঙালি রীতি-পদ্ধতি ব্যবহার করে। তাঁর শিল্প-মানসের সহজাত প্রবণতা ছিল বাঙালি জীবনের শেকড়ের প্রতি গভীর আগ্রহ; তাই কিত্তনখোলা নাটকে বর্ণনাত্মক নাট্য-রীতির সূত্রপাত করেন। বলাবাহুল্য, নাটকে বর্ণনারীতি সেলিম আল দীনের আগে আধুনিক বাংলা নাটকে ব্যবহৃত হয় নি। এই বর্ণনামূলক পদ্ধতিতে মধ্যযুগের বাংলা সাহিত্যে মঙ্গলকাব্যাদি নাটকীয় ভঙ্গিতে রচিত হয়েছিল। সেলিম আল দীন এ ধরনের নাটক রচনার ক্ষেত্রে শুধু বিষয়বস্তু নির্মাণে কৃতিত্বের পরিচয় দেন নি, একই সাথে নাট্যকাহিনী উপস্থাপনা-রীতিতেও নতুন মাত্রা সংযোগ করেছেন বাংলা নাট্যসাহিত্যের ইতিহাসে। কিত্তনখোলা নাটকের কাহিনী তিনি নিরেট বাঙালি জীবন থেকেই শুধু গ্রহণ করেন নি; তিনি এ নাটকে সত্যিকার অর্থে নানান শ্রেণী-পেশার প্রান্তিক মানুষের জীবনচিত্র উপস্থাপন করেছেন।
কিত্তনখোলা রচনার মধ্য দিয়ে সেলিম আল দীন নাট্যকার হিসেবে প্রাচ্যচেতনায় তথা বাঙালির নিজস্ব প্রকরণশৈলী নির্মাণ করেন। করিম বাওয়ালির শত্র“ অথবা মূল মুখ দেখা দিয়ে সেলিম আল দীন প্রাচীন বাংলা জনপদ ও প্রান্তিক গ্রামীণ মানুষের প্রতি যাত্রা শুরু করেন। তুলে আনেন বাঙালি জীবনের নিজস্বতা এবং প্রথাগত সমাজের জীবন-যাপনের রীতি-পদ্ধতি, আচার-আচরণ সাংস্কৃতিক চিত্রের ইতিকথা। নাট্যকার সূক্ষ্ম দৃষ্টিতে দেখেছেন, উপলব্ধি করেছেন এবং তা জীবন-রঙ্গমঞ্চের বাস্তবতা থেকে থিয়েটার হলের দর্শকদের রঙ্গমঞ্চে নিয়ে এসেছেন। তিনি বাঙালি জীবন ও সমাজের যে চিত্র নাট্যানুষঙ্গে তুলে ধরেছেন, তা বাঙালি রীতি-পদ্ধতি ব্যবহার করে। তাঁর শিল্প-মানসের সহজাত প্রবণতা ছিল বাঙালি জীবনের শেকড়ের প্রতি গভীর আগ্রহ; তাই কিত্তনখোলা নাটকে বর্ণনাত্মক নাট্য-রীতির সূত্রপাত করেন। বলাবাহুল্য, নাটকে বর্ণনারীতি সেলিম আল দীনের আগে আধুনিক বাংলা নাটকে ব্যবহৃত হয় নি। এই বর্ণনামূলক পদ্ধতিতে মধ্যযুগের বাংলা সাহিত্যে মঙ্গলকাব্যাদি নাটকীয় ভঙ্গিতে রচিত হয়েছিল। সেলিম আল দীন এ ধরনের নাটক রচনার ক্ষেত্রে শুধু বিষয়বস্তু নির্মাণে কৃতিত্বের পরিচয় দেন নি, একই সাথে নাট্যকাহিনী উপস্থাপনা-রীতিতেও নতুন মাত্রা সংযোগ করেছেন বাংলা নাট্যসাহিত্যের ইতিহাসে। কিত্তনখোলা নাটকের কাহিনী তিনি নিরেট বাঙালি জীবন থেকেই শুধু গ্রহণ করেন নি; তিনি এ নাটকে সত্যিকার অর্থে নানান শ্রেণী-পেশার প্রান্তিক মানুষের জীবনচিত্র উপস্থাপন করেছেন।
কিত্তনখোলা নাটকের কাহিনী একটি চলমান জীবনের চিত্র। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় থেকে কিত্তনখোলা গ্রামে মনাই বাবার মাজার গড়ে ওঠে একদিন। তখন থেকেই বাবার মাজারকে কেন্দ্র করে প্রতি বছর মাঘী পূর্ণিমায় ঐ গ্রামে তিন দিনের এক মেলা অনুষ্ঠিত হয়। আর গ্রামের মেলা অর্থ
দূর-দূরান্তের গ্রাম থেকে নানা মানুষের আগমনে একটি মিলনের ঐক্যতান সৃষ্টি হয়। গ্রাম্য ঐ মেলার আয়োজন সম্বন্ধেও নাট্যকারের চোখ এড়িয়ে যায় না। কেউ মেলায় আসে টুকিটাকি জিনিসপত্র কিনতে,
কেউ আসে বায়োস্কপ দেখতে কেউবা যাত্রা৭ দেখতে। মেলায় টুইটাম গ্রাম থেকে এসেছে দিনমজুর সোনাই। সোনাই কিত্তনখোলা নাটকের কেন্দ্রীয় চরিত্র নয়;
অন্যভাবে বলা যায়,
এ নাটকে কোনো কেন্দ্রীয় চরিত্র নেই। তবে নাট্যকাহিনীতে সোনাইয়ের উপস্থিতি বেশিরভাগ জায়গা জুড়ে। নাট্যকারের নিকট জানা যায় সোনাইয়ের পরিচয়। সোনাইয়ের পিতা ছিলেন জোলা বা তাঁতী। সোনাইয়ের বাবার বসতি ছিল পাবনা জেলায়। এক সময় তাদের জমিজমা ছিল;
অর্থাৎ তারা সম্পন্ন গেরস্ত ছিল। সোনাইয়ের দাম্পত্য জীবন ছিল,
ঘরে বউ ছিল,
সুখও ছিল। কিন্তু এখন তার সোনাইয়ের কিছুই নেই;
অনেকটা বলতে গেলে হৃতসর্বস্ব। সোনাই আবার মৃগী রোগী। ইদল হক কন্টাক্টরের কাছ থেকে জমি বন্ধক রেখে সোনাই চার হাজার টাকা ঋণ নিয়েছিল। পরিশোধ করতে পারে নি আজো ঋণের টাকা। এজন্য ইদু কন্টাক্টর কৌশলে সোনাইয়ের শেষ সম্বল ভিটেমাটির জমিটুকুও ঋণের দায়ে কেড়ে নিতে চায়। ফলে সোনাইয়ের যে পরিচয় আমাদের সামেনে ভেসে ওঠে তার প্রেক্ষিতে তাকে নিম্নশ্রেণীর শুধু নয়,
নিম্নশ্রেণীর মধ্যেও আরো একধাপ নিচের না বলে উপায় থাকে না।
সোনাইয়ের ঋণের টাকা বেড়েছে;
আর ইদু কন্টাক্টরের জমির লোভ। ফলে উভয় চরিত্রের মধ্যে সংঘাত অনিবার্য হয়ে পড়েছে। সোনাই খেটে খাওয়া মানুষ;
কিন্তু ইদু শোষক শ্রেণীর প্রতিভূ। তবে ইদুর অতীত ইতিহাস বলে ইদুও এককালে নিম্নবিত্তেরই মানুষ ছিল। কারণ,
পঞ্চাশের মন্বন্তরে ইদুর মা সাতদিন না খেয়ে অবশেষে মণ্ডল বাড়িতে খিঁচুড়ি খেয়ে মারা গেছে। ইদু দিনমজুরী করেছে হুরমত কাজীর বাড়িতে। শরীর খাটিয়ে পেটে-ভাতে বেঁচে থেকেছে। কিন্তু সেই বেঁচে থাকার আরেক নাম সংগ্রাম। কাজীর বাড়িতে কাজ করে সারাদিনে ইদুর জুটতো একবেলা ভাত আর দুইবেলা ফেন। তবে ইদু তার ভাগ্য বদলে নিয়েছে,
নিজের বুদ্ধির জোরে;
সে আজ কিত্তনখোলা মেলা কমিটির শক্তিধর পুরুষ।
No comments